সঙ্কটাবর্ত: যুদ্ধবিরতির সংবাদ পাওয়ার পর প্যালেস্টাইনের সমর্থনে মিছিল, তেহরান, ১৭ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স।
পুরনো বছরের প্রচুর জটিল অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যার আপাতদৃষ্টিতে সমাধান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেটি হল গাজ়ায় ইজ়রায়েল ও হামাস-এর মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। এই পরিস্থিতিতে সবার আগে প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধবিরতি কি আদৌ শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে?
মনে রাখা দরকার, গত বছরে এই সংঘর্ষের জের শুধুমাত্র ওই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ওই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের কূটনীতি এবং ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। উদাহরণ: ইরান ইজ়রায়েলের সংঘর্ষ। পশ্চিম এশিয়া দু’টি প্রভাবশালী শিবিরে বিভক্ত। এক দিকে ইরানের প্রভাবান্বিত ‘অ্যাক্সিস অব রেজ়িস্ট্যান্স গোষ্ঠী’ যার মধ্যে আছে হিজ়বুল্লা, হামাস থেকে শুরু করে ইরাকের আইআরআই গোষ্ঠী, এবং ইয়েমেন-এর হুথি মিলিশিয়া গোষ্ঠী; অন্য দিকে ইজ়রায়েল, আমেরিকা ও তথাকথিত ইউরোপীয় বৃহৎ গোষ্ঠী। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা অংশ যদি শুধু ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইন সমস্যা হয়, তা হলে অন্য অংশ জুড়ে আছে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তর জটিল রাজনীতির আঙ্গিক যার অনেকাংশ জুড়ে আছে ইরানকে কেন্দ্র করে নানা রকম সমীকরণ।
ইরানের খনিজ সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান, এ সব কিছুই তাকে পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে, তাই বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে ইরানের উপর নিয়ন্ত্রণ ‘জ্যাকপট’ পাওয়ার মতো। ১৯৫৩ সালে ব্রিটেন এবং আমেরিকা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোসাদেককে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে রেজা শাহ পহলভিকে ক্ষমতায় বসায়। ১৯৭৯ সালে যখন আয়াতোল্লা খোমেনি-র নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তখন তা পশ্চিমের ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘ক্ষমতা’ ও ‘স্বার্থ’ এই দু’টি শব্দ আলাদা মাত্রা বহন করে। তাই বরাবর আমেরিকার চেষ্টা থেকেছে ইরানকে বেকায়দায় ফেলার, অর্থনৈতিক অবরোধ যার অন্যতম একটি পন্থা, ট্রাম্পের সময় যা প্রবল বৃদ্ধি পায়, ফলে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ফলে যে সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়বে এটা সহজেই অনুমেয়।
অন্য দিকে, ইরান ও বিগত শতকগুলিতে ধীরে ধীরে পশ্চিম এশিয়া যে নিজের প্রভাব ও ক্ষমতা ক্রমশই বাড়িয়ে চলেছে সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। আমেরিকা জানে যে এই অঞ্চলে তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান, ফলে তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য কোনও সহযোগীকে খুঁজেছে। ইজ়রায়েল তার সেই সহযোগী, ইজ়রায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন করার অন্যতম কারণই এই যে, আমেরিকা কোনও ভাবেই পশ্চিম এশিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে চায় না। সুতরাং, বর্তমানে যদি শুধু ইজ়রায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যার আঙ্গিক থেকে কেউ এই সংঘর্ষকে বিশ্লেষণ করতে চায়, তা হলে তা এই সমস্যার সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরবে না। অন্য দিকে, ইরানও খুব ভাল ভাবে জানে তাদের কাছে ‘গ্রেটার ইভিল’ আমেরিকা হলেও তার সহযোগী ‘লেসার ইভিল’ ইজ়রায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি এবং তার একমাত্র উপায় হচ্ছে ইজ়রায়েল-বিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করা।
বিগত দশক থেকেই ইজ়রায়েল এবং ইরানের মধ্যে এক ধরনের ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, কিন্তু ইরান বা ইজ়রায়েল কেউই সরাসরি একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়নি, কিন্তু ইজ়রায়েল ইরানের ভূ-খণ্ডে এবং তাদের সেনানায়কদের যে ভাবে আক্রমণ ও হত্যা করেছিল, তা ইরানকে ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারই প্রকাশ ঘটে অক্টোবরে ইরানের তেল আভিভ আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। ফলে সমস্যা যে আরও জটিল আকার ধারণ করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ইরান বর্তমানে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। ২০১৯ থেকে জ্বালানির দাম বাড়া, কিংবা হিজাব পরা, নানা কিছু নিয়ে নানা বিক্ষোভ চলছে সেখানে। বহির্বিশ্বে ইরানের যে ছবি উঠে এসেছে তা খুব একটা ইতিবাচক নয়। ফলে ইরানের রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার অন্যতম পথ এখন নিজেকে পশ্চিম এশিয়ার রক্ষাকর্তা তথা বৃহত্তর আরব স্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে দেখানো। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের ফলে, আলি খামেনেই যতই বলুন না কেন যে এর প্রভাব অ্যাক্সিস অব রেজ়িস্ট্যান্স-এর উপর পড়বে না। সিরিয়া ভূ-রাজনীতির দিক থেকে ‘অ্যাক্সিস’ এর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। রাশিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে একত্র হয়ে ‘আস্তানা’ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। সিরিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতাবস্থার উপরই সে সময়ে নির্ভর করছিল ইরাক, জর্ডন, লেবানন এই অঞ্চলগুলির স্থিতি। এই পরিস্থিতিতে ইরানের সিরিয়া নীতির পুরোটাই নির্ভর করছে এইচটিএস ইরানের প্রতি কী নীতি নিচ্ছে তার উপর। এইচটিএস-এর উপর আমেরিকা, ইজ়রায়েল ও তুরস্কের প্রভাব যে যথেষ্ট পরিমাণে আছে তা ইরান বিলক্ষণ জানে, ফলে সিরিয়ার পরিস্থিতির উপরও তাদের কড়া নজর আছে। সিরিয়ার পরিস্থিতি অতঃপর কোন দিকে এগোয়, সেটা ইরান তথা গোটা পশ্চিম এশিয়ার জন্যই অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই।
এ ছাড়া ইয়েমেন-এর সানা এয়ারপোর্ট ইজ়রায়েল ২৬ ডিসেম্বর আক্রমণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে যে হামাস, হিজ়বুল্লা, সিরিয়ার পর এ বার তাদের লক্ষ্য ইয়েমেন তথা হুতি। এই কার্যক্রমকে দু’ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়,প্রথমত, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েল যে স্পষ্টতই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, তারা নিজেরাও এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। ফলে তাদের কাছে এই অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব সবচেয়ে ভাল ভাবে স্থাপন করার এইটাই সুযোগ।তারা খুব ভাল ভাবে জানে, আমেরিকা বা অন্যান্য ইউরোপীয় গোষ্ঠীর কেউই তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবে না। গাজ়ায় যুদ্ধবিরতি ইজ়রায়েল মেনে নিয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণই কিন্তু ইজ়রায়েল বুঝতে পেরেছে যে, আপাতত তাদের গাজ়া থেকে আর নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই, তাই তারা এখন ‘অ্যাক্সিস’-এর অন্য গোষ্ঠীর দিকে মনোনিবেশ করেছে। এর প্রথম ধাপ যদি সিরিয়া হয়, দ্বিতীয় ধাপ হয়তো ইয়েমেন।
ফলে পশ্চিম এশিয়া যে বারুদের স্তূপের উপর বসে আছে তাতে এখনই পরিবর্তন হওয়ার আশা কম। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের শক্তিবৃদ্ধি যে আমেরিকার কাছে আলাদা রকমের সদর্থক ইঙ্গিত বহন করে, সেটা বুঝতে পারা কঠিন ব্যাপার নয়— কারণ ইরানকে সামনে থেকে আক্রমণ করা বর্তমানে আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়, সুতরাং আমেরিকা এ ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলেরই মুখাপেক্ষী হবে। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলও এটা বোঝে যে, ইরানকে প্রত্যক্ষ আক্রমণ করার চেয়ে পরোক্ষ আক্রমণ করা বেশি ফলপ্রসূ হবে। তাই তারা ইরানের সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীদের উপরই আবার নিজেদের দৃষ্টি ফিরিয়েছে। এর সুবিধে হল, এক দিকে যেমন প্রত্যক্ষ ভাবে সেই গোষ্ঠী আঘাতপ্রাপ্ত হবে, পরোক্ষ ভাবে তা ইরানকেও সমস্যার মধ্যে ফেলে দেবে। এই গোষ্ঠীগুলির শক্তি হ্রাস ইরানের কর্তৃত্বকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেবে। ইরান সমস্যায় পড়লে শুধু ইজ়রায়েল নয়, আমেরিকার কাছে পশ্চিম এশিয়ায় এবং উত্তর আফ্রিকায় নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা অনেক সহজসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন।
বাস্তবিক, আমেরিকা হয়তো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ইজ়রায়েলকে এমন ভাবে সাহায্য করবে যাতে পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রটি পুনর্নির্মিত হবে। সেই পুনর্নির্মাণে সুবিধে হবে ইজ়রায়েলেরই, এবং ঘুরপথে আমেরিকারও। আবার অন্য দিকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইরান-সহ পশ্চিম এশিয়ার অন্য অঞ্চলগুলি সহজে তা হতে দেবে না।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গাজ়ায় যুদ্ধবিরতি আদৌ ওই অঞ্চলে দীর্ঘকালীন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ আছে। এই জটিল নেতিবাচক আন্তঃসম্পর্কিত রাজনীতির আঙ্গিককে যদি খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে হয়, তা হলে রবীন্দ্রনাথের ভাষা আবার ধার করতে হয়: “শান্তির দোহাই পেড়ে এরা লড়াই করে এবং সেই লড়াই-এর ধাক্কাতেই সেই শান্তিকে মারে; আজকের দিনে শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কালকের দিনের যে শক্তিকে জাগিয়ে তোলে, আবার তারই বিরুদ্ধে পর দিন থেকে যুদ্ধের আয়োজন করতে থাকে।” তাই, সত্যিই ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা হবে না নতুন কোনও শক্তি জেগে উঠবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া হয়তো আর কিছু করারও নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy