Advertisement
৩১ জানুয়ারি ২০২৫
Illegal Construction

যখন ছাদ ভেঙে পড়ে

কলকাতা পুর নিগমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে ১২৭টি বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত হলেও, ভাঙা হয়েছে মাত্র ২৭টি।

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫৩
Share: Save:

গত বছর গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ে, তাতে তেরো জন মানুষের প্রাণ যায়, আহত হন অনেকে। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে সমবেদনা জানান, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন। বাড়িটি পুকুর বুজিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে নির্মিত হচ্ছিল বলে জানা যায়। কলকাতার মহানাগরিক বহুতলটি নির্মাণকালের প্রসঙ্গ তুলে দুর্ঘটনার দায় বাম আমলের ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন বটে, সঙ্গে জানিয়েছিলেন, অতঃপর কলকাতা পুরসভার তরফে কড়া নজরদারি হবে, অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে। তার পর প্রায় আট মাস কেটে গেছে। কলকাতা পুর নিগমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে ১২৭টি বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত হলেও, ভাঙা হয়েছে মাত্র ২৭টি।

সম্প্রতি একের পর এক বহুতল বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়ার ঘটনা সামনে আসায় নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অল্প দিনের ব্যবধানে বাঘাযতীন, ট্যাংরা, বরাহনগর-সহ নানা এলাকা থেকে বহুতল হেলে পড়ার খবর আসছে। কামারহাটি ও বিধাননগর পুর এলাকাতেও অনুরূপ বিপত্তি ঘটেছে বলে খবর। প্রায় সব হেলে পড়া বাড়ি অবৈধ ভাবে নির্মিত, বা সেগুলির অংশবিশেষ অবৈধ ভাবে পরিবর্ধন-পরিবর্তন করা হয়েছে। বিরোধীরা পুর নিষ্ক্রিয়তা ও প্রোমোটারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের অনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগে সরব। কিন্তু যাঁরা রাতারাতি নিরাশ্রয় হলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শাসক বা বিরোধী কোনও তরফেই সদর্থক আশ্বাসবাণী শোনা যায়নি।

কলকাতায় বহুতল ভেঙে পড়া নতুন নয়। ১৯৮৯ সালের ১৮ জুন ড. রাজেন্দ্র রোডে একটি সাত তলা বাড়ি ভেঙে এগারো জন মানুষ নিহত হন। বহুতলটির নির্মাতা গ্রেফতার হওয়ার পর তৎকালীন রাজ্য সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশে তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়। ১৯৯০-এ বাঙুর হাউজ়িং কমপ্লেক্সের একাংশ ও ১৯৯৫-এ শিবালিক অ্যাপার্টমেন্ট ভেঙেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার ও নিয়ম-বহির্ভূত নির্মাণের প্রমাণ মেলে। সেই ইতিহাস থেকে যে উত্তরসূরিরা কোনও শিক্ষাই নেননি, সাম্প্রতিক কালে একের পর এক বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট।

কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় উপর্যুপরি বহুতল হেলে পড়ার কারণ হিসাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক শিক্ষক জানিয়েছেন, কলকাতা শহরের পলিমাটিতে বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে বাড়ির উচ্চতা অনুযায়ী যতটা গভীরে ভিত্তি নির্মাণের প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্মাণব্যয় কমানোর তাগিদে তা মানা হয়নি। বাড়িগুলির পরস্পরের মধ্যে বিজ্ঞান অনুসারে যে ন্যূনতম ব্যবধান থাকার কথা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা-ও রাখা হয়নি। অথচ পুর নিগমই হোক বা পুরসভা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় কাউন্সিলরের সুপারিশক্রমে সংশ্লিষ্ট পুর প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। আইনমতে, নির্মাণকালে নিয়মিত নজরদারিও হওয়ার কথা। কাউন্সিলর বা বেতনভুক পুরকর্মী, কেউই দায় এড়াতে পারেন না।

অবৈধ নির্মাণ ও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের ফলে বাড়ি ভেঙে যাতে ক্রেতার সম্পত্তিক্ষয় ও প্রাণহানি না ঘটে, সে জন্য ভারত সরকার ‘দ্য রিয়েল এস্টেট (রেগুলেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৬’ নামে আর একটি আইন প্রণয়ন করেছে। এর উদ্দেশ্য: স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্মাণের গুণমান, নিয়মাবলি ও নির্দিষ্ট সময়ের নির্মাণপর্ব সম্পাদন নিশ্চিত করা, যাতে নির্মাণশিল্পের বিকাশের সঙ্গে উপভোক্তার স্বার্থও সুরক্ষিত হয়। এর অব্যবহিত পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একই উদ্দেশ্যে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজ়িং ইন্ডাস্ট্রি রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০১৭’ নামে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু ২০২১-এর মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় আইনের সমান্তরাল, এবং উপভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় দুর্বল ধারাগুলি অভিন্ন বিবেচনা করে এই আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ফলে এ রাজ্যেও কেন্দ্রীয় আইনটি বলবৎ করার উদ্দেশ্যে ২০২১-এর জুলাইয়ে রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় বিধি (রুলস) প্রণয়ন করেছে, এবং সেই অনুযায়ী প্রোমোটারের কাজে স্বচ্ছতা, সময়ানুবর্তিতা ও নির্মাণ সামগ্রীর গুণমান নজরদারির জন্য ‘রিয়েল এস্টেট রেগুলেটরি অথরিটি’ (রেরা) গঠন করেছে।

এই আইন অনুযায়ী আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় নির্মাণের ক্ষেত্রেই ২০০ বর্গমিটারের বেশি পরিসরে, বা ন্যূনতম ছ’টি অ্যাপার্টমেন্ট আছে এমন প্রতিটি প্রকল্প ‘রেরা’য় নিবদ্ধীকরণ বাধ্যতামূলক। এর প্রাক্‌শর্ত হিসেবে প্রকল্পের জমির মালিকানা, মাটির চরিত্র, ব্যবহার্য নির্মাণ সামগ্রীর গুণমান, প্রকল্প সম্পূর্ণ করার মেয়াদকাল ইত্যাদি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরসভা বা পুর নিগম অনুমোদিত নকশা দাখিল করা অপরিহার্য। প্রোমোটারের তরফে কোনও ভাবে আইন লঙ্ঘিত হলে বা উপভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে চুক্তিবদ্ধ প্রোমোটারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি আর্থিক জরিমানার এক্তিয়ারও রয়েছে। সুতরাং নির্মাণকারী সংস্থা ও প্রকল্পটি ‘রেরা’য় নিবদ্ধীকৃত কি না দেখে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে, উপভোক্তা সুরক্ষিত থাকবেন।

ক্রেতা সুরক্ষা আইন ২০১৯ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত উপভোক্তার ক্ষতিপূরণেরও সংস্থান রয়েছে। কিন্তু সে তো ঘটনা ঘটার পর। আইন ও সরকারি সুরক্ষাবলয় সত্ত্বেও যাদের প্রশ্রয়ে বা নিষ্ক্রিয়তায় শহরের যত্রতত্র অবৈধ নির্মাণ গড়ে উঠছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে সাধারণ মানুষের দুরবস্থা যেমন রোধ করা যাবে না, তেমনই রাজ্যে নির্মাণ শিল্পের বিকাশও অধরা থেকে যাবে।

অন্য বিষয়গুলি:

KMC Tilted Building Kamarhati Municipality Bidhannagar municipality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy