ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন রূপে দেখা গিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের খণ্ডচিত্র। এ ক্ষেত্রে বীরভূমের অবদানও কম নয়। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী প্রদর্শিত অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব সমান্তরাল ভাবেই এই জেলা উপরে পড়েছিল। বীরভূমের বহু বিপ্লবীর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রচেষ্টা ও সঙ্কল্প তা পাথেয় করতে সাহায্য করেছিল।
সংগ্রামী, দৃঢ়চেতা অনেক বিপ্লবীর কার্যকলাপ অনালোকিত থেকে যায়। আজ এই লেখার মাধ্যমে বীরভূম জেলার তেমনই এক বিপ্লবীর কথা তুলে ধরছি। বীরভূমের স্বাধীনতা আন্দোলনের মানচিত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি আমোদপুর নিবাসী রজতভূষণ দত্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছাড়াও তাঁকে আমোদপুরের রূপকার হিসাবে। আমোদপুর তাঁর ভাবনার উপরে ভর দিয়েই সমাজ ভাবনার বাস্তব রূপ পেয়েছে আমোদপুর বালিকা বিদ্যালয়, চিনি শিল্প কেন্দ্র, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
১৯০৮ সালের ৭ মে আমোদপুরে জন্মগ্রহণ করেন রজতভূষণ দত্ত। পিতা রাখালচন্দ্র দত্ত ও মাতা ত্রিনয়নী দেবীর পঞ্চম সন্তান ছিলেন তিনি। পিতার ছোট্ট ব্যবস্যা ও সামান্য ভূ- সম্পত্তির উপরে তাঁদের দিন নির্বাহ হত। বয়স যখন ১২ বছর, তখন বরিশাল এবং ঢাকার কিছু বিপ্লবীকে অন্তরিত বা নজরবন্দি করে রাখা হয় আমোদপুর গ্রামে। এঁদের সংস্পর্শে এসেই দেশপ্রেমের প্রাথমিক শিক্ষা পান রজতভূষণ। এই বয়স থেকে তিনি সঙ্কল্পবদ্ধ হন, যে কোনও উপায়ে ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়াতে হবে। তবেই পরাধীনতার বেড়ি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে। ১৯২৮-’২৯ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। এই পর্বে তিনি তাঁর সমমনষ্ক বিভিন্ন বন্ধুর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে তৎকালীন ভারতের উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং তাঁর থেকে মুক্তির উপায়। এর সঙ্গে তিনি বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সদস্য হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯২৮ সালে কলকায়া, জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষ চন্দ্র বসু বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে এক গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনেও যোগ দেন রজতভূষণ। বিলিতি মদের দোকানে ধর্মঘট করার জন্য রজতভূষণকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
ইতিমধ্যে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু সাংসারিক জীবনে নিজেকে খুব একটা বন্দি রাখতে পারেননি নিজেকে। তিনি ভালই জানতেন যে তাঁর স্ত্রীর যত্নের দায়িত্ব তাঁর পরিবার নিতে পারবে। ১৯৩০ সালে রজতভূষণ যুগান্তর নামে এক গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির দ্বারা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের যজ্ঞে নিয়োজিত হন। এই যুগান্তর দল ছিল অনুশীলন সমিতির অভ্যন্তরীণ একটি সংগঠন। এই পর্ব থেকেই রজতভূষণ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের নির্মূল করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। এ ক্ষেত্রে বিপ্লবী জগদীশ ঘোষের সান্নিধ্য রজতভূষণকে অনেক সাহায্য করেছিল। খয়রাশোল গ্রামে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ প্রদর্শন করার সুবাদে পুলিশ জগদীশ ঘোষকে গ্রেফতার করে।
এর পরে আইন অমান্য আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে বীরভূম জেলাও। রজতভূষণ এই আন্দোলনে যোগ দেন। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকদের মেদিনীপুরের কাঁথিতে পাঠানের জন্য সিউড়িতে একটি কেন্দ্র খোলা হয়। এই সময় রজতভূষণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সিউড়ি জেলে বন্দি হন। সেই সময় এই জেলে বন্দি ছিলেন জগদীশ ঘোষ, দ্বারিক রায়, সমাধীশ রায়, মণিলাল ঘোষ, হারান খাঙারের মতো বিপ্লবীরা। রজতভূষণের সঙ্গে এই সময় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগ্রার লুণ্ঠনের অন্যতম নেতা অম্বিকা চক্রবর্তী সাথে পরিচয় ঘটে। অম্বিকা চক্রবর্তীকে তখন সিউড়ি জেলের টিবি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল।
বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার প্রস্তুতির প্রাথমিক ধাপের বুনন এই জেলে মধ্যেই হয়। জেলের মধ্যে অন্য বন্দিদের মেলামেশায় কোনও বাধা না থাকায় সেখানেই চলত তাঁদের সাংগঠনিক আলোচনা। জেলের মধ্যে গোপানে আসত কিছু বিপ্লবী সাহিত্য পত্র। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তাঁরা এক আন্দোলন কর্মসূচি তৈরি করেন। ১৯৩০-র ৭ই মে বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটি এক সভার আয়োজন হয়। এই কর্মসূচিকে নিয়ে সদ্যস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। জেলা কংগ্রেস দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। জগদীশ ঘোষ, রজতভূষণ দত্ত-সহ কিছু বিপ্লবী আমোদপুরের নিকট কুচুইঘাটা গ্রামে সমান্তরাল ভাবে তৈরি করেন ‘বীরভূম জেলা যুব সমিতি’। এই যুব সমিতির সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচির আড়ালেই বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার বীজ নিহিত ছিল ।
রাজনৈতিক ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা, অম্বিকা চক্রবর্তীকে সিউড়ি জেল থেকে উদ্ধার করার মতো লক্ষ্যগুলিকে সামনে রেখে ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল এই সংগঠন বীরভূম জেলার বিভিন্ন অংশে ডাকাতি, লুণ্ঠন, আগ্নেয়াস্ত্র ছিনতাই কাজে লিপ্ত থাকে। এই সমস্ত বিপ্লবী কার্যকলাপের সমষ্টি হল বীরভূম ষড়যন্ত্রের পরিণিতি। সিউড়ি জেল থেকে অম্বিকাবাবুকে উদ্ধারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই যুব সমিতি তাদের কাজ আরম্ভ করে। এর জন্য রজতভূষণ প্রাণগোপাল মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে অম্বিকাবাবুর সেলের এক ডুপ্লিকেট চাবি বানান। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর পর একে একে সিউড়ি, দুবরাজপুর, ময়ূরেশ্বর, লাভপুর, হেতমপুর, সুবলপুর, শ্রীকণ্ঠপুরে লুটের মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ইত্যাদি রসদ জোগাড় করতে থাকে ওই সমিতি। এই সংগঠনের সূচনা জগদীশ ঘোষের হাত ধরে হলেও পরবর্তী কালে রজতভূষণ দত্তই নেতৃত্ব দেন। ১৯৩২ সালে বেঙ্গল ক্রিমিন্যাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুসারে জগদীশকে গ্রেফতার করা হয়।
রজতভূষণ এই সমিতি দায়িত্ব পাওয়ার পরে ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে দুবরাজপুরের কাছে হালসত গ্রামে বিপ্লবীদের এক গোপন অধিবেশনে ‘যুব সমিতি’র নতুন নামকরণ হয় ‘নিউ সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন’। বৈপ্লবিক কার্যকলাপ চালানোর জন্য সদস্যেরা কাজের এলাকা ছয়টি শাখায় ভাগ করে নেন। রজতভূষণ একটি কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন।
১৯৩২ পুলিশ সুপার সামসুদ্দোহা বীরভূম-সহ পার্শ্ববর্তী জেলার ডাকাতি ও লুণ্ঠণের ঘটনা সম্পর্কে বিপ্লবী সংগঠনের যোগসূত্র আছে বলে পুলিশের আইজি-র কাছে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিখানি ঐতিহাসিক বীরভূম ষড়যন্ত্র মমলার সূত্রপাত হিসাবে ধরা হয়। বিপ্লবী সংগঠন এই সমস্ত সান্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ইতি টানতে পুলিশ তৎপর হয়। এরফলে ১৯৩৩ সালের ১৬ জুন কমিটির অন্যতম সদ্যস্য জয়গোপাল চক্রবর্তীকে বীরভূম ভালাস গ্রাম থেকে বেশ কিছু ইস্তাহার সহ তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে। অব্যবহতির পরই আর এক সদ্যস্য নিত্যগোপাল ভৌমিক পুলিশ হাতে ধরা পড়েন। আরও কয়েক জন গ্রেফতার হন। কিন্তু বিপ্লবী রজতভূষণকে খুব সহজে করায়ত্ত করতে পারেনি পুলিশ। কারণ ১৯৩২ সালে থেকেই তিনি আত্মগোপন করে থাকতেন। পরে পুলিশ রজতভূষণ যে বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতেন, তার সন্ধান পায়। সেই বাড়িতে থেকে তাঁকে বন্দি করার আগেই একটি পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে জলের মধ্যেই ধরে ফেলে। তাঁর রাইস মিল তল্লাশি করে বেশ কিছু অস্ত্র ও পটাশিয়াম সাইনাইডের দুটি ফাইল ঊদ্ধার করে।
১৯৩৩ সালে ডিসেম্বরে পুলিশ জগদীশ ঘোষ ও রজতভূষণ দত্ত-সহ ৪২ জনের নামে এক অভিযোগ আনে এবং তাঁদের কাজকর্ম ব্রিটিশ বিরোধী ষড়যন্ত্র বলে স্বীকৃত হয়। ১৯৩৪ সালের ১৪ই জুলাই ৪২ জন বিপ্লবীর মধ্যে ২১ জনকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২১ ধারার রাষ্টবিরোধীতার মামলা দাখিল করা হয়। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে খ্যাত। ২৫ সেপ্টেম্বর মামলার রায় বের হয়। রজতভূষণ দও ও প্রাণগোপাল মুখোপাধ্যায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিতদের মধ্যে কয়েক জনকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ হিসাবে চিহ্নিত করে আন্দামানের সেলুলার জেলে দ্বীপান্তর করা হয়। বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার মূল চক্রী হিসাবে রজতভূষণ দত্তের নাম দ্বীপান্তরের বন্দিদের তালিকায় সর্বপ্রথমেই ছিল। জেলে থাকাকালীন, তিনি নির্মম মানসিক অত্যাচারের শিকার হতেন। আন্দামানে কঠোর শ্রমে নিযুক্ত থাকতেন। ১২ বছরের দীর্ঘ বন্দিজীবনে তিনি সেলুলার জেলে কাটান ১৯৩৫ থেকে ’৪৫ সাল পযর্ন্ত। মাঝে ’৪৪ সালে তাঁকে জেল থেকে একবার মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু আন্দামান জেলে তিনি ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বন্দি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় জেলের নিয়মানুসারে জেলে গেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার হন। ’৪৫-এ তিনি মুক্তি পান এবং আমোদপুরে ফিরে আসেন।
এই মহান বিপ্লবী তথা আমোদপুরে রূপকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৮০-র ৮ নভেম্বর। অমোদপুর রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে তাঁর জন্মের শতবর্ষ উদ্যাপন করা হয় এবং একটি আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের জন্য রজতভূষণ দত্তের ছবিকে বীরভূম জেলা পরিষদ তাদের অধিবেশন কক্ষে স্থান দিয়েছে।
(লেখক বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, মতামত ব্যক্তিগত)