চার দিকে এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। রাস্তায় ছেলেপিলেরা যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করছে। এমনকি অভিজাত আলোচনাতেও, যুদ্ধের কথাই উঠছে বার বার। সারা দেশেই এক ছবি।
গত কয়েক দশকে এই রকম পরিস্থিতি কয়েক বার তৈরি হলেও, ভারত যুদ্ধে যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ কী রকম? সরল উত্তর: যেটা ইউক্রেনে, প্যালেস্টাইনে হচ্ছে, কিংবা আফগানিস্তানে হয়েছে। যখন দেশের বড় অংশ, কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও সার্বভৌমত্ব আক্রান্ত হয় এবং তার বিরোধিতায় পাল্টা আক্রমণ করতে হয়, সেটাই যুদ্ধ।
১৯৯৯ সালে কার্গিলেও এটা হয়নি। লাটিয়েন্স দিল্লি বা ইসলামাবাদের ‘রেড জ়োন’ বা ‘ডিপ্লোমাটিক অনক্লেভ’ আক্রান্ত হয়নি, কারও সার্বভৌমত্বে চাপ পড়েনি। কাশ্মীর ও তার সীমান্ত আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কাশ্মীর আক্রান্ত হওয়া আর দিল্লি-মুম্বই আক্রান্ত হওয়া এক জিনিস নয়। তথ্যের কথাই যদি বলতে হয়, কার্গিলে যত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার থেকে বেশি ভারতীয় মণিপুর ও দক্ষিণ ছত্তীসগঢ়ে সম্প্রতি মারা গিয়েছেন, সন্ত্রাসে।
এমতাবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর ভারত কি যুদ্ধ চায়? প্রধানমন্ত্রী মোদীকে যাঁদের পছন্দ নয়, তাঁরাও কিন্তু একটা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে করতে পারবেন না— তিনি যুদ্ধ করতে চান না। গত দশ বছরে অন্তত দু’বার যুদ্ধ করার সুযোগ এসেছিল। যেমন, যখন ২০২০ সালে চিন ভারতের বিশ জন সৈনিককে হত্যা করেছিল— ভারত তখনও যুদ্ধের রাস্তায় হাঁটেনি। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাংবাদিক সম্মেলনে (মার্চ, ২০২২) বলেছিলেন, তিনি চিনের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে দু’বছর ধরে কথা বলছেন। অর্থাৎ, গলওয়ান সংঘর্ষের সময় থেকে। মানে, ভারত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল না।
তা সে না হয় বোঝা গেল। চিন যাঁরা চালান, তাঁরা মুসলমান নন, ফলে যুদ্ধ করে ভোট বাড়ে না। আর চিনের সেনাবাহিনীও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়, কখন কী করে বসে ঠিক নেই। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান বলেই বেহালায় এই উত্তেজনা। সেই প্রসঙ্গে মনে পড়বে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর আরও একটা সুযোগ ছিল পুলওয়ামার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার— কিন্তু তিনি তেমন কিছু করেননি। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়িয়ে গিয়েছেন। কেন?
সহজ উত্তর। যুদ্ধ এক বার শুরু হলে গভীরে চলে যেতে পারে, আর গভীরে গেলে, মানে সীমান্তে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর থেকে ইসলামাবাদ ঢুকে গেলে, ফেরা মুশকিল হতে পারে। তখন যুদ্ধ নিজের গতিতে চলতে থাকে। আফগানিস্তানে জর্জ বুশ (কনিষ্ঠ) যুদ্ধ শুরু করেন। তার পরে তিন জন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ চালিয়ে যান। ২০২১ সালে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি ‘কস্টস অব ওয়র’ বলে একটি প্রতিবেদন করেছিল। বলেছিল, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন তাঁদের চিকিৎসার খরচ ও ক্ষতিপূরণ বাদ দিয়েও বিশ বছরে যুদ্ধে খরচ হয়েছে ২.৩১ লক্ষ কোটি ডলার (দৈনিক ৩১.৬ কোটি ডলার)। যাবতীয় খরচ সুদসমেত ধরলে ২০৫০ সালে এই অঙ্ক সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছবে, এও জানানো হয়েছিল। এটা ভারতীয় মুদ্রায় কত হয়, সে হিসাব করতে গিয়ে রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় থেমে গেলাম।
রাশিয়া যুদ্ধে ঠিক কত খরচ করছে জানা যায় না, কারণ মস্কো সব বলে না, ভারতেরই মতো। তার পরেও রাশিয়া বিপদে, একাধিক রিপোর্ট বলছে। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে পেন্টাগন জানিয়েছিল, দৈনিক ২৮.৯ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে পুতিনের।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বোঝেন। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর উপরে নানা চাপ রয়েছে। ‘মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ বা সামরিক-শিল্প জোটের চাপ। সামরিক-শিল্প জোট কী? প্রতিরক্ষা ঠিকাদার, সশস্ত্র বাহিনী, প্রভাবশালী রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের জোট— যা জনস্বার্থের চেয়ে বেসরকারি সামরিক সংস্থার লাভকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ১৯৬১ সালে এই শব্দবন্ধ আবিষ্কার ও ব্যবহার করে তাঁর বিদায়ী ভাষণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজ়েনহাওয়ার বলেছিলেন, “সরকারি পরিষদে, সামরিক-শিল্প জোটের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে… বিপথগামী শক্তির বিপর্যয়কর উত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে, থাকবে।” যত যুদ্ধ হয়, এই শক্তির লাভ ততই বেশি। যে কারণে আমেরিকাকে বার বার যুদ্ধ করতে হয়, জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানানোর কাজ চিনে পাঠিয়ে। পাকিস্তানের অন্তত দু’জন গুরুতর পণ্ডিত— আয়েশা সিদ্দিকা এবং মারিয়া রশিদ— দেখিয়েছেন, সামরিক-শিল্প বানাতে গিয়ে পাকিস্তান নিজেদের জন্যই কী বিপদ ডেকে এনেছে।
অন্য দিকে, ভারতের অর্থনীতি এখন অত্যন্ত ভাল অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের তাবড় অর্থনীতি বিশ্লেষক সংস্থা এ কথা বলছে। গত সেপ্টেম্বরে, বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলেছে, বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে ভারতের সবচেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরে সম্ভাব্য বৃদ্ধি হার ৭%। যুদ্ধ করে এই হার ধরে রাখা অসম্ভব। একই সঙ্গে যুদ্ধ যাদের সঙ্গে, তাদের অবস্থাটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
আফগানিস্তান-পাকিস্তান (আফ-পাক) আন্তর্জাতিক জেহাদ পর্যবেক্ষক আব্দুল সৈয়দ জানিয়েছেন, “২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বৃহৎ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ২৬২টি হামলা চালিয়েছিল। এর পর সর্বোচ্চ আক্রমণ হয়েছে গত মার্চে, ২৬০টি।” অসামরিক নাগরিকের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কর্মী থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারেরা বিরাট সংখ্যায় মারা গিয়েছেন। সোজা কথায়, পাকিস্তানের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ চলছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আল কায়দার দক্ষিণ এশীয় শাখা ‘আল কায়দা ইন দি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ প্রতি মাসে একটি পত্রিকা বার করে, নওয়ায়-গাজ়ওয়া-এ-হিন্দ। এই কাগজে তারা ইজ়রায়েল, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি দেশকে এন্তার গালমন্দ করে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি গালমন্দ করে— পাকিস্তানকে। তাদের বক্তব্য, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং নেতারা এমন লুট করেছেন যে, মানুষ খেতে পায় না। তারা অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অতএব ভারতের আর বিশেষ কিছু না করলেও চলে।
অর্থনীতির প্রশ্নে, পাকিস্তানের প্রধান সংবাদপত্র ডন-এ ২৮ এপ্রিলই বলা হয়েছে, “পঞ্চাশ বছর আগে আমরা একটি প্রবল গতিশীল অর্থব্যবস্থা ছিলাম, আজ সিঁড়ির একেবারে নীচে পৌঁছেছি।” পাকিস্তান যে প্রায় পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের উপরে নির্ভরশীল তা-ও বলা হয়েছে।
এটাও বোঝা প্রয়োজন, চরম দরিদ্র দেশ সব সময়ই মন্দায় থাকে। আফগানিস্তানে গিয়ে ‘তোমাদের দেশে শুনলাম রিসেশন’ বললে পঠানরাই হাসাহাসি করবেন। খাইবার পাখতুনখোয়াতেও তাই। অথচ ভারতের বেঙ্গালুরু বা বেহালায় কিন্তু এই চিত্র নয়— বারামুলাতেও নয়। সুতরাং, ভাবা ভাল— মৃতদেহে আঘাত করতে গিয়ে যদি হাত ভেঙে যায়, তবে কি আদৌ মারতে যাওয়া উচিত?
তার মানে কি এই, পাকিস্তানের সঙ্গে সব সময়ে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে? নিশ্চয়ই নয়। কূটনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবই পাল্টে গিয়েছে। এ সব মাথায় রেখে কী ভাবে পাকিস্তানের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, তা নরেন্দ্র মোদী আমাদের থেকে ভাল বোঝেন, ফলে এ নিয়ে খামোকা শব্দ খরচ করে লাভ নেই।
যুদ্ধ তাই প্রেমের মতো। প্রথমে মজা, তার পরে মূর্ছা। ওই রাস্তায় ভারত চট করে হাঁটবে বলে মনে হয় না, যদি না পাকিস্তান একটা সাংঘাতিক কিছু করে বসে। তবে সেই আশঙ্কা খুব বড় নয়, কারণ উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধ সামলে পূর্ব সীমান্তে আরও একটা যুদ্ধ চালানোর অবস্থায় আছে কি ইসলামাবাদ? মনে হয় না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)