মতিচুড় মসজিদের ভিতর। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।
কবির ভাষায় ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ...’ বা বলা যায়, ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি ....।’ আমাদের অনেকের কাছে আজও অনেক কিছুই অজানা, অচেনা।
তাই বীরভূমের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের লক্ষ্যে আসা পর্যটক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষের কয়েক জন কিছু সময় হাতে নিয়ে ঘুরে যান প্রাচীন কালে এক সময় বীরভূমের রাজধানী থাকা রাজনগরে। ঐতিহাসিক কেন্দ্র রাজনগরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইমারত, স্মৃতিসৌধ, দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে আজও মুগ্ধ হন তাঁরা। ফিরে গিয়ে রাজনগরে নিজেদের চোখে দেখা সব কিছু বর্ণনা করেন পরিচিতদের কাছে। ইতিহাস ও জনশ্রুতির গল্প বলেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের।
সেগুলি জানা ও শোনার পরে অনেকেই আগ্রহ দেখান রাজনগর ভ্রমণের। এখন ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন প্রকল্পেও জায়গা পাচ্ছে রাজনগর ও সেখানকার ইতিহাস। অনেকে গবেষণাও করছেন প্রাচীন ও ঐতিহাসিক এই কেন্দ্রকে নিয়ে। শিক্ষামূলক ভ্রমণে আসেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পড়ুয়ারা। ইতিহাস চর্চা করে চলেছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই অন্তত এক বার এই জনপদে ঘুরে যান। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে কিছুটা হলেও প্রচারের আলোয় আসতে সক্ষম হয়েছে সাবেকি এই নগর। এখানকার একাধিক স্থাপত্য, নির্মাণশৈলী এমনকী প্রাচীন মসজিদের গায়ে টেরাকোটার কারুকাজে মিশ্র সংস্কৃতির খোঁজ পাওয়া যায়৷ অতীতে রাজাদের দেখানো সহনশীলতা, শান্তি ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত আজও অটুট এই এলাকায়। তাই ইদ, মহরম, বিশ্ব নবীদিবস, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সাইবাবা ও অনুকূল ঠাকুরের জন্মদিবস পালন, মাজারে উরস ও নবান্ন উৎসবে আজও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমজনতার ভিড় জমে এখানে। সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয় উভয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতায়। যা জেলা তো বটেই রাজ্যের বুকেও অন্যতম এক দৃষ্টাম্ত স্থাপন করে বলে মনে করেন অনেকে৷ কেউ কেউ রাজনগরকে ‘শান্তিনগর’ বলেও অভিহিত করেন।
এখানকার দর্শনীয় স্থান ও স্মৃতিসৌধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— রাজবাড়ি ও ইমামবাড়া, কালীদহ, হাওয়াখানা বা হাওয়া মহল, ঐতিহাসিক গাব গাছ (এই গাছে ইংরেজ আমলে সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা মঙ্গল মাঝিকে ফাঁসি দেওয়া হয় বলে কথিত রয়েছে), হামাম বা স্নানাগার, মতিচুড় মসজিদ, ফাঁসিঘর, তোরণ, হাতিশালা, বারুদ ঘর, প্রাচীন ভদ্রকালী ও সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, রানিগ্রামের মদনমোহন মন্দির, বৈষ্ণবপদকর্তাদের স্মৃতিবিজড়িত পাটমুড়ি, ভবানীপুরের মা ভবানীর মন্দির, বেলেড়া ও কবিলাসপুরের মন্দির। এ ছাড়া ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন ফুলবাগানের দেওয়ান সাহেবের মাজার, ছোট কালীদহ, ছোট বা নকল রাজবাড়ি, মীরসাহেবের মাজার, মাজারের কাছে মীরবাবার আমলে তৈরি পুরনো মসজিদ, কুশকর্ণী নদীর তীরের শ্মশান চত্বর, ডাকবাংলো ও বড় সাঁকোর মাঝে হজরত সাহেবের আখড়া, তার পাশে সবুজে ঘেরা আশ্রম মুগ্ধ করে অনেককে।
এই সব উল্লেখযোগ্য ইমারত, প্রাসাদ, মহল ও স্মৃতিসৌধগুলির মধ্যে কয়েকটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন কর্তৃক সরকারি আর্থিক সহায়তায় ইতিমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে৷ অদূর ভবিষ্যতে বাকিগুলিও যথাযথ ভাবে সংস্কার করা হবে বলে আশায় রয়েছেন অনেকে৷ এক সময় রাজা বীরচন্দ্র ওরফে বীররাজা রাজত্ব করেছেন রাজনগরে। তাঁর নামানুসারে ‘বীরভূম’ নামটি এসেছে বলে কারও কারও অভিমত। তবে অন্য মতও রয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আরও জানা যায়, অতীতে রাজনগরের নাম ছিল লক্ষ্ণুর। লক্ষণ সেন, বল্লাল সেনদের বংশের প্রতিনিধিরা এখানে রাজত্ব করেছেন৷ লক্ষণ সেনের নামানুসারে এমন নামকরণ বলে মনে করেন কেউ কেউ। সেই সময় ওড়িশার রাজা নরসিংহ দেবও রাজকার্য পরিচালনা করেন এখানে।
ঐতিহাসিক কালীদহ পুকুরের মধ্যে সুদৃশ্য (যদিও এখন তা ঝোপ, গাছপালায় ভর্তি) দ্বীপ আকৃতির হাওয়াখানা বা হাওয়া মহল তৈরি হয় তাঁরই আমলে। রাজনগর ছোটবাজার, গাংমুড়ি, মীরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুশকর্ণী নদীর নামকরণ তিনিই করেন বলে অনুমান অনেকের। এই নদীটিকে কুশকর্ণিকাও বলা হয়।
ভদ্রকালী মন্দিরের কাছে নতুন গ্রামে বসবাস করেন ভারতী পদবির ব্রাহ্মণেরা। কথিত রয়েছে, রাজা নরসিংহদেব ওই ভদ্রকালী মন্দির স্থাপন করেন ও ভারতীদের এখানে নিয়ে আসেন। আজও এখানে তাঁদের বংশধরেরা পুজোর কাজে নিযুক্ত।
এর পরের ইতিহাস এক এক জন লেখক বা ঐতিহাসিক এক এক রকম ভাবে তুলে ধরেছেন। কেউ বলেন, বীররাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন পাঠান বংশের রাজারা। কেউ বলেন, মল্লযুদ্ধে হারিয়ে রাজনগরের সিংহাসনে বসেন আফগান পাঠান প্রতিনিধিরা। বিশ্বাসঘাতকতা, হত্যার বিষয় কোনও কোনও ঐতিহাসিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেন বলে জানা যায়। যাই হোক, বীররাজার পরে এখানে সিংহাসন লাভ করেন সুদূর আফগানিস্তান থেকে আসা পাঠান বংশের প্রতিনিধিরা। সেই বংশের আদিপুরুষ হলেন সামস খান (১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর উত্তরসূরী জোনেদ খান রাজত্ব শুরু করেন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাসবিদেরা জানান, সেই বংশের রাজা আসাদুল্লা খান রাজকার্য পরিচালনার পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করেন। রাজ্যপাট ছেড়ে জঙ্গলে ঘেরা ফুলবাগান নামে জায়গায় ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন হন ও এক সময় সিদ্ধিলাভ করেন। ফুলবাগানে তাঁর সমাধি হয়৷ এটি দেওয়ান সাহেবের মাজার বলে পরিচিত। এখানে প্রতি বছর ২৩ মাঘ পবিত্র ঊরস পালন করা হয়। গ্রামীণ মেলাও বসে। আগে বেশ কয়েক দিন ধরে মেলা হতো। জায়গাটি নির্জন ও লোকালয় থেকে দূরে হওয়ায় নিরাপত্তার কথা ভেবে বর্তমানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দিনের মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় ভক্ত, দর্শনার্থীদের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকেও কয়েক হাজার ভক্ত এসে ভিড় করেন মাজার ও মেলা চত্বরে।
(লেখক সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনগর রাজ পরিবারের সদস্য, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy