Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ভুটানেও ‘দিদি’ই রইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

এক ঘণ্টা বৈঠকের পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলে ফেললেন, ‘‘দিদি থ্যাঙ্ক ইউ!’’

থিম্পুতে বাণিজ্য প্রতিনিধি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

থিম্পুতে বাণিজ্য প্রতিনিধি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
থিম্পু শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ১৯:৫৮
Share: Save:

এক ঘণ্টা বৈঠকের পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলে ফেললেন, ‘‘দিদি থ্যাঙ্ক ইউ!’’

সরকারি প্রোটোকল মোড়া ভুটান সফরে এ ভাবেই বোধহয় প্রোটোকল ভেঙে গেল। সন্ধ্যেবেলার বাণিজ্য সম্মেলনে (বিজনেস সামিট) ভুটানের অর্থনীতি বিষয়কমন্ত্রী নরবু ওয়াংচুক আর এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দিদি। ভারতে যেমন ওনাকে সবাই দিদি বলে জানে, আমরাও তাঁকে সেই ভাবেই চিনি। সাদা সুতির শাড়ি আর হাওয়াই চপ্পল পড়ে তিনি ক্ষমতার অলিন্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর এই সাদামাটা জীবনযাপন এবং ক্ষমতায় থেকেও নিরহঙ্কার থাকা আমাদের প্রেরণা যোগায়, তাই তিনি আমাদেরও প্রিয় দিদি।’’

পঁচিশ বছর পরে আরও এক বার পশ্চিমবঙ্গের আর এক মুখ্যমন্ত্রীর ভুটান সফর শুরু হল এমনই আন্তরিক আবহে। ১৯৯০ সালের জুনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ভুটান সফরে এসেছিলেন। তাঁর উপস্থিতির প্রতিটি পরতে ছিল গুরুভার সমীহ। দেখেছিলাম, জ্যোতি বসুকে স্বাগত জানাতে প্রোটোকল ভেঙে থিম্পু থেকে পারো-তে নেমে এসেছিলেন তৎকালীন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক। শুনেছিলাম, জওহরলাল নেহরু ছাড়া অন্য কোনও ভারতীয় নেতার ক্ষেত্রে এটা হয়নি। আজ মমতাকে স্বাগত জানাতে রাজা বা প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে না এলেও (এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী) আন্তরিকতার টানে প্রোটোকলের সীমানা কিন্তু ভাঙলই। মমতার এ দিনের প্রথম সরকারি কর্মসূচিও ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক।

নানা কারণেই ভারতের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক মাসের মধ্যে, গত বছরের জুনে, নরেন্দ্র মোদীর প্রথম বিদেশ সফরের ঠিকানা ছিল থিম্পু। চিনের নিরিখে ভুটানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ভারতের কাছে জরুরি। আবার ভুটানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য-সহযোগীও ভারত। ভুটানের রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে ভারতে। যার একটি বড় অংশ বিদ্যুৎ। ভুটানের চুখা, বাসো চু, কুড়ি চু প্রভৃতি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদনের পঁচাত্তর ভাগই কিনে নেয় ভারত। আনুমানিক হিসেবে এখানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৮৫০ মেগাওয়াটের মতো। ৪৫০ মেগাওয়াট নিজেদের জন্য রেখে ভুটান সবটাই বিক্রি করে ভারতকে। ভারতের রফতানি বাণিজ্যেরও বিরাট বাজার ভুটানে।

ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা আরও বাড়ানো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরও পাখির চোখ। আজ সন্ধ্যায় বাণিজ্য প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি তাই ভুটানের শিল্পোদ্যোগীদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বার বার বললেন, ‘‘আপনারা পশ্চিমবঙ্গে আসুন। আমরা আপনাদের ভাই-বোন-আত্মীয় ভেবে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। এখানে এলে সব পাবেন।’’

এর আগে তোবগের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রাধিকার পেল উত্তরবঙ্গ থেকে ভুটান পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ সুগম করা, সেইসঙ্গে পর্যটনের উন্নয়ন-সহ নানা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) চার দেশের মধ্যে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের পথ মসৃণ করতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক টাকা দিচ্ছে। এ বছরেই জুন মাসে ভুটানে মোটর-ভেহিকল্স চুক্তি তৈরি হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তৈরি হয়েছে প্রোটোকলের খসড়া। ডিসেম্বরে শিলিগুড়িতে তা চূড়ান্ত রূপ পাবে। সেই বৈঠকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানান মমতা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি নিশ্চয়ই আমন্ত্রণ রক্ষার চেষ্টা করবেন।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মমতার কাছে তুলে ধরেন তোগবে। তা হল ভারত-ভুটান রেলপথ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জানান, হাসিমারা থেকে পাসা খা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের যে প্রতিশ্রুতি ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, প্রায় এক দশক হয়ে গেলেও তার বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভারত এবং ভুটানের মধ্যে এ ব্যাপারে যে আলোচনা হয়েছিল তাতে রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কোনও অংশ ছিল না। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যে কিছু জায়গায় জমি পাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে, তাই রেল যোগাযোগের কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। মমতা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি নিশ্চয়ই দেখব যাতে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় এই কাজে কোনও সমস্যা না হয়।’’

উত্তরবঙ্গ থেকে থিম্পু পর্যন্ত যাত্রী-বাস দ্রুত চালু করার উপরেও জোর দিয়েছেন মমতা। সঙ্গে এনেছেন রাজ্যের পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পর্যটন সচিব অজিত বর্ধনকে। তাঁর আশা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভুটানের মধ্যে পর্যটনের আরও প্রসার হবে। গত বছর ভারত থেকে এক লক্ষ ৩৩ হাজার পর্যটক ভুটানে এসেছেন, যার মধ্যে ৬৮ হাজারই পশ্চিমবঙ্গের। এই হিসেব মাথায় রেখেই মমতার নয়া প্রস্তাব, ব্যাঙ্কক এবং পারো-র মধ্যে যে বিমান চলাচল করে তাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্ডাল এবং কলকাতা রুটে ঘুরিয়ে দেওয়া হোক। অর্থাৎ, ব্যাঙ্কক-অন্ডাল-কলকাতা-পারো। পর্যটন ব্যবসা বাড়ানোর নিরিখে মমতার এই প্রস্তাব কতটা কার্যকর হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আজকের ভারত-ভুটান বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা শুনে হাততালির বহর বড় কম হয়নি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE