নিউ ইয়র্কের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পেপসিকোর সিইও ইন্দ্রা নুয়ি। ছবি: পিটিআই।
শুধু সরকারের সদিচ্ছার কথা শোনালে চিঁড়ে ভিজবে না। আর্থিক থেকে প্রশাসনিক— সংস্কারে আনতে হবে জেট গতি। না হলে উপুড় হবে না লগ্নির ঝাঁপি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে স্পষ্ট ভাষায় এই বার্তাই দিল ‘ফরচুন-৫০০’। শীর্ষস্থানীয় শিল্পকর্তাদের ক্লাব।
এ দেশের শিল্পপতিরা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে একই কথা বলেছিলেন। নিউ ইয়র্কে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন শিল্পকর্তারাও মুখোমুখি বৈঠকে হুবহু সেই কথাই বললেন।
এমনটা নয় যে, শিল্পপতিদের কাছ থেকে এমন কড়া বার্তা অপ্রত্যাশিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর। তাই মার্কিন সফরে যাওয়ার আগেই এই বিষয়ে হোমওয়ার্ক সেরে নিয়েছিল সাউথ ব্লক। এটা ঘটনা যে, বিপুল জনসমর্থন নিয়ে গত বছর মে মাসে মোদী ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমী দুনিয়ায় ভারত সম্পর্কে আগ্রহ এবং প্রত্যাশা দুইয়েরই পারদ চড়েছিল। এই বছরের গোড়ায় ভারত সফরে এসে সে কথা বুঝিয়েও দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
কিন্তু সেই প্রত্যাশার পারদটা দ্রুত নামতে থাকে সংস্কারে ভাঁটা পড়ার পর থেকে। ফলে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে আমেরিকার। আজ তারই প্রকাশ ঘটেছে মার্কিন সংস্থাগুলির সিইও-দের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে। মোদী অবশ্য তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, শিল্প ও ব্যবসার পথ আরও মসৃণ করতে লাল ফিতের ফাঁস কাটানোর কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রশাসনিক সংস্কার আমার অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে।’’ তাঁর সরকার স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ প্রশাসন তৈরি করে সরকারি প্রক্রিয়ার সরলীকরণের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের ব্যবস্থা করতে চায় বলেও শিল্পকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, বিনিয়োগ আনতে গেলে সংস্কারের কাজগুলো যে দ্রুত সেরে ফেলা জরুরি, তা তিনি নিজেও বোঝেন। মোদীর কথায়, ‘‘আমরা জানি যে, দুনিয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না।’’ যা শোনার
পরে ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকাভুক্ত সিইওরা নরেন্দ্র মোদীকে বলেছেন, তাঁরা সকলেই ভারতের বিষয়ে উৎসুক। তবে তাঁদের সম্মিলিত দাবি, আর্থিক সংস্কারের গতিটা আরও একটু বাড়ানো হোক।
নিউ ইয়র্কে ৪২টি মার্কিন সংস্থার শীর্ষকর্তাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যে ৪২টি সংস্থার মোট সম্পদ প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি ডলার। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র সুরে তাঁদের ভারতে লগ্নির আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদী। আইবিএম, ফোর্ড, পেপসিকো, বোয়িং, লকহিড মার্টিন, মাস্টার কার্ড, ডাও কেমিক্যালস, সিটিগ্রুপ, স্যানডিস্ক, গোল্ডম্যান সাচ— কে ছিল না সেখানে! সিইও-দের এই চাঁদের হাটে মোদী গত ১৬ মাসে তাঁর সরকার কী সংস্কারের কাজ করেছে, তার খতিয়ান পেশ করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে, তা-ও জানিয়েছেন। মার্কিন সিইও-দের আশ্বস্ত করতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গোটা বিশ্বের লগ্নিকারীরাই এখন ভারতের উপর ভরসা রাখছেন। গোটা বিশ্বে যেখানে বিদেশি লগ্নি কমছে, সেখানে ব্যতিক্রম ভারত। এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। সকলের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে জানতে চেয়েছেন, ভারত সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবছেন? ভারতে লগ্নির পরিকল্পনা রয়েছে কি না? কী আশা করছেন মোদী সরকারের থেকে? মার্কিন সিইও-রা কী বলছেন? বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপের সারসংক্ষেপ, ‘‘ওঁরা বলেছেন, যা করছেন, সেটাই করে যান। শুধু গতিটা বাড়ান।’’ জে পি মর্গানের সিইও জেমস ডাইমন বলেন, ‘‘মার্কিন সংস্থাগুলির মোদ্দা কথা হল, যেটা করছেন, করে যান।’’
চলতি মাসের শুরুতে এ দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মোদী। বুঝতে চেয়েছিলেন, কেন তাঁরা বড় বিনিয়োগ করছেন না। শিল্পমহল বলেছিল, থমকে যাওয়া সংস্কারের চাকায় গতি ফেরাক সরকার। যে ভাবেই হোক। আলগা হোক লাল ফিতের ফাঁস। তবেই আরও লগ্নি করতে ভরসা পাবেন তাঁরা। এক কথায়, মোদী সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করুক।
শিল্পমহলের অভিযোগ অকারণ নয়। জমি অধিগ্রহণ থেকে জিএসটি— সংস্কারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে। বিহার ভোটের কথা ভেবে কেন্দ্র জমি বিল নিয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। শ্রম আইনের সংস্কারও দূর অস্ত্। এই কাজগুলিই দ্রুত সেরে ফেলার দাবি তুলেছিলেন মুকেশ অম্বানী-সাইরাস মিস্ত্রিরা। বলেছিলেন, প্রশাসনিক সংস্কার দ্রুত সেরে লাল ফিতের ফাঁস আলগা করুক সরকার। সংসদে বাধা এলে বিকল্প পথ খোঁজার কথাও বলেছিলেন তাঁরা। দেশীয় শিল্পপতিদের লগ্নিতে উৎসাহের অভাব বিদেশি লগ্নি দিয়ে পূরণ করতে চাইছিলেন মোদী। কিন্তু নিউ ইয়র্কে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী টের পেলেন, বিদেশি শিল্পপতিদের চাহিদাও আলাদা কিছু নয়। সেখানেও খালি হাতে গেলে শূন্য ঝোলা হাতেই ফিরতে হবে। লগ্নি মিলবে না।
মার্কিন সিইও-দের নৈশভোজের আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিখ্যাত শেফ বিকাশ খন্নাকে। ঠান্ডাই চিকেন থেকে কেশর শিরমল— আয়োজনে ত্রুটি রাখেননি বিকাশ। দেড় ঘণ্টার বৈঠক-নৈশভোজের পর আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর মার্ক ওয়েইনবার্গার বলেন, ‘‘আমরা সবাই সংস্কারের গতি নিয়ে চিন্তিত। আমরা আরও দ্রুত, আরও বেশি কাজ দেখতে চাই। যার লক্ষ্য হবে পরিকাঠামো ও বিদ্যুতে বিনিয়োগ। জিএসটি চালু করে কর সংস্কার, যাতে গোটা দেশে অভিন্ন বাজার তৈরি হয়।’’ সিগমা-অলড্রিচের সিইও রাকেশ সচদেব বলেন, ‘‘অবশ্যই আমরা দ্রুত বদল দেখতে চাই। বুঝি যে, প্রক্রিয়াটা কঠিন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর জমানার শুরুতে বেশ কিছু বদল এনেছিলেন। যা অনেক দিন দেখা যায়নি। আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী।’’
মার্কিন কর্পোরেটদের সঙ্গে মোদীর বৈঠকের পর আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অরুণ কে সিংহ জানান, ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার জন্য অতিরিক্ত কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তার বিষয়ে কিছু পরামর্শ এসেছে। এগুলি সরকার খতিয়ে দেখবে। অনেকেই বিমার মতো ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা খোলার পরে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মার্কিন সিইও-দের জানিয়েছেন, তিনি সরকারি
নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে, বেসরকারি ক্ষেত্রকে আরও উৎসাহ দেওয়ার পক্ষে। অরুণের দাবি, একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অধিকাংশ শিল্পপতিই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে এটা ভারতের জন্য খুবই ভাল সময়।
লগ্নি এখনই না আসুক, বিশ্বের সেরার সেরা শিল্পপতিদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কিন্তু কুড়িয়েছেন মোদী। একাধিক মার্কিন শিল্পপতি মানছেন, মোদীর সদিচ্ছা রয়েছে। সেটাকেই এ বার কাজে লাগিয়ে দেখাতে হবে। ব্ল্যাকস্টোনের প্রেসিডেন্ট হ্যামিলটন জেমস যেমন মোদীতে মুগ্ধ। তাঁর মতে, মোদী সমস্যাগুলো বোঝেন। আবার ম্যারিয়টের সিইও আর্ন সরেনসনের মতে, মোদী সমস্যাগুলো শোনেন। ভারতের ছবিটা উজ্জ্বল করতে তিনি আগ্রহী। ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকাভুক্ত সংস্থার সিইও-দের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বিশ্বব্যাঙ্কের প্রধান এবং মার্কিন মিডিয়া ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের সঙ্গেও আলাদা ভাবে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। মার্কিন মিডিয়া ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে দাবি ওঠে, দেশ জুড়ে ডিজিটাল সংযোগ ও ফোর জি পরিষেবা দ্রুত চালু করার ব্যবস্থা হোক। বৈঠকের পর নিউজ কর্প প্রধান রুপার্ট মার্ডক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে ট্যুইট করেছেন, ‘মোদীই স্বাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ নেতা’।
এই সংক্রান্ত আরও খবর
আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইএস: প্রধানমন্ত্রী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy