Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ক্ষিপ্ত

বড় রায়ের আগে মন্ত্রীদের দাবড়ানি হাসিনার

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী। এমনকী, দাবি তুলেছিলেন তাঁর অপসারণেরও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জন্য দুই মন্ত্রীকে তুমুল ভর্ৎসনা করলেন সোমবার।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হা

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী। এমনকী, দাবি তুলেছিলেন তাঁর অপসারণেরও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জন্য দুই মন্ত্রীকে তুমুল ভর্ৎসনা করলেন সোমবার। এ দিন সকালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “কেউ যা খুশি বলতে চাইলে আগে মন্ত্রিত্ব ছাড়ুন। তার পরে রাস্তায় গিয়ে যা মন চায় বলুন।”

মন্ত্রিসভার বৈঠকে আগে থেকে ঠিক করা বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হার বিরুদ্ধে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বিরূপ মন্তব্যের বিষয়টি নিজেই তোলেন হাসিনা। জানিয়ে দেন, এটা সরকারের অবস্থান নয়। দুই মন্ত্রীর আচরণে সরকার বিব্রত হয়েছে, সরকারের প্রধান হিসেবে তিনিও বিরক্ত হয়েছেন। কামরুল বা মোজাম্মেলের নাম না-করে হাসিনা বলেন, “দুই মন্ত্রীকে জানাতে চাই, তাঁদের বক্তব্যের দায় সরকার নেবে না। আর তাঁরাও মন্ত্রী হিসেবে কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে যা খুশি তাই বলতে পারেন না।”

বিতর্কের শুরু সরকারি আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির একটি নির্দেশকে ঘিরে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করায় জামাতে ইসলামির নেতা মীর কাসেম আলি সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ জন বিচারপতির একটি বেঞ্চে সেই মামলা চলছে। আজ, মঙ্গলবারই সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার রায় দিতে পারে। কিছু দিন আগে এর শুনানির সময়ে সরকারি কৌঁসুলিদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘রাজনীতি না-করে ঠিক ভাবে যুক্তি উপস্থাপন করুন।’’ এর পরেই শনিবার এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল দাবি করেন, বিচারপতি সিন্হাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গড়ে ফের এই মামলার শুনানি করতে হবে। কারণ, তিনি জামাতের সুরে কথা বলছেন। প্রধান বিচারপতির ইস্তফা চান মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মন্ত্রীদের এই আচরণের নিন্দা করায় রবিবার তাঁকেও ‘জামাত-বিএনপির দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত করেন খাদ্যমন্ত্রী। শাসক দলের অনেকেই মনে করছেন, বিচার বিভাগের প্রধান ব্যক্তির বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের এই আক্রমণ ও তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা এক দিকে যেমন অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত নিদর্শন, তেমন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক রীতিনীতিরও পরিপন্থী।

মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত এক মন্ত্রী আনন্দবাজারকে জানান, বৈঠকে এ দিন প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। অভিযুক্ত দুই মন্ত্রীও সেখানে হাজির ছিলেন। নাম না করেই তাঁদের কার্যত তুলোধোনা করেন হাসিনা। বলেন, ‘‘দেশের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কী কথা বলা যায়, আর কী বলা যায় না— মন্ত্রীদের সেটুকু বোধ থাকবে না? সরকারের প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা নিজেদের মনগড়া কথা বলবেন! আর লোকে ভাববে এ সব সরকারের কথা!” প্রধানমন্ত্রীর এই কড়া অবস্থানে বাংলাদেশের আইনজীবী মহলের পাশাপাশি শাসক দলের একটা অংশও আশ্বস্ত হলেন। কারণ, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের আক্রমণ আসলে সরকারেরই কৌশল কি না, বা খোদ প্রধানমন্ত্রীর এতে সায় রয়েছে কি না— এই নিয়ে কিছুটা ধন্দ তৈরি হয়েছিল। এ দিন যা দূর করলেন হাসিনা।

শাসক দলের এক নেতা জানান, অভিযুক্ত মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়ে হাসিনা দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদেরও বার্তা দিলেন। বাংলাদেশে কট্টর ও মৌলবাদী মুসলিমদের সমর্থন কোনও দিনই আওয়ামি লিগের দিকে ছিল না। এই সরকার পাকিস্তানের দোসর জামাত নেতাদের কাঠগড়ায় তোলার পরে বিরোধিতা আরও বেড়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বড় অংশ ঐতিহাসিক ভাবেই আওয়ামি লিগের সমর্থক। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়ে চলা মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রধান শিকারও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের সমর্থন ধরে রাখাটাও হাসিনার দায়। গত বছর প্রথম কোনও অ-মুসলিমকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করে সংখ্যালঘুদের প্রশংসা ও ধন্যবাদও কুড়িয়েছেন হাসিনা। আইন বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবেও বিচারপতি সিন্হা বাংলাদেশে শ্রদ্ধেয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ওই নেতার কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে সরকারের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। অথচ কিছু মন্ত্রী সে সব হিসেব না-করেই বালখিল্য আচরণ করছেন। এতেই মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি শেখ হাসিনা।’’

সরকারের সমর্থক আইনজীবীদের একাংশ কিন্তু মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী কামরুল-মোজাম্মেলের মতো মন্ত্রীদের ভর্ৎসনা করে বিষয়টিতে ইতি টানার চেষ্টা করলেও ক্ষতি একটা হয়েই গিয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, হাসিনা সরকার ইতিমধ্যেই তাদের বিচার শুরু করেছে। সেই বিচার প্রক্রিয়া ও আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধী দল জামাতে ইসলামি ও বিএনপি সরব। এই
পরিস্থিতিতে একটি মামলার বিচার চলাকালীন খোদ মন্ত্রীরাই বিচারপতিকে নিশানা করায় বিরোধীরাও রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে। রায় বিরুদ্ধে গেলে বলা হবে, মন্ত্রীরা চাপ সৃষ্টি করে সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করেছেন। এই আইনজীবীদের আশা, প্রধানমন্ত্রী দাবড়ে দেওয়ার পরে মন্ত্রীরা ফের মুখ খুলে আর সমস্যা বাড়াবেন না।

অন্য বিষয়গুলি:

hasina primeminister bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE