Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

চাপে সরকার, নিঃশব্দে মমতা ছুটলেন কুমারগ্রাম

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হচ্ছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে। মাঝে মাঝেই অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছে হাতির পালের হুঙ্কার। চাপড়ামারি বনবাংলোয় ব্যালকনির চেয়ারে একাই বসে এক জন! শীতের ডুয়ার্সে কোনও পর্যটক হলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কিন্তু বনবাংলোর ব্যালকনিতে ইতস্তত পায়চারি করছেন যিনি, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! মন্ত্রী নেই, আমলা নেই। চেনা পারিষদেরাও সঙ্গে নেই! এই ভরা সারদার বাজারে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে একলা কী করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

চিন্তিত। চাপড়ামারি যাওয়ার আগে বাগডোগরা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।  বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

চিন্তিত। চাপড়ামারি যাওয়ার আগে বাগডোগরা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হচ্ছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে। মাঝে মাঝেই অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছে হাতির পালের হুঙ্কার। চাপড়ামারি বনবাংলোয় ব্যালকনির চেয়ারে একাই বসে এক জন!

শীতের ডুয়ার্সে কোনও পর্যটক হলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কিন্তু বনবাংলোর ব্যালকনিতে ইতস্তত পায়চারি করছেন যিনি, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! মন্ত্রী নেই, আমলা নেই। চেনা পারিষদেরাও সঙ্গে নেই! এই ভরা সারদার বাজারে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে একলা কী করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

তাঁর গন্তব্য আসলে কুমারগ্রাম। অসমে গণহত্যার পরে সে রাজ্য থেকে আসা শরণার্থীরা আশ্রয় শিবিরে কেমন আছেন, নিজের চোখে দেখতে চান মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সে ইচ্ছার উদয় এবং তার রূপান্তর, দুই-ই শুক্রবার ঘটেছে রীতিমতো নাটকীয় ভাবে। যাকে বলে কাক-পক্ষীও টের পায়নি! অন্তত তাঁর সরকার ও দলে!

কুমারগ্রামে শরণার্থীদের পাশে তাঁর সরকার যে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়াবে, বৃহস্পতিবারই বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সে দিন কোনও ঘোষণা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী কুমারগ্রাম যাচ্ছেন, এই খবর তাঁর মন্ত্রিসভার সতীর্থেরা এ দিন পেয়েছেন যখন মমতা বিমানবন্দরের পথে! মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবের মতো প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের পক্ষেও তখন আর সঙ্গে যাওয়ার উপায় ছিল না। এমনকী, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবও আগাম খবর পাননি যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর তালুকে আসছেন!

কেন হঠাৎ এ ভাবে তড়িঘড়ি কুমারগ্রাম ছুটলেন মুখ্যমন্ত্রী? তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, সারদা-কাণ্ডে জেরবার মমতা এখন যে কোনও হাতিয়ার আঁকড়ে ধরতে চান। গণহত্যার পরে অসমের আশ্রয়প্রার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বার্তা দিতে চান, তাঁর সরকার প্রকৃতই মানবিক। কিন্তু অসমের ঘটনায় ইতিমধ্যেই আসরে নেমে গিয়েছে বিজেপি। অসমে গিয়ে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। এর পরে অপেক্ষা করলে পাছে উত্তরবঙ্গেও জমি ছিনিয়ে নেয় বিজেপি, তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে কুমারগ্রাম যাত্রা? কিন্তু ঘোষণা করেও তো যেতে পারতেন? শাসক দলের এক নেতার মন্তব্য, “উনি হয়তো ভেবেছেন ঘোষণা করে রাখলে আগে যদি অন্য কেউ পৌঁছে যায়!”

অগত্যা শুধু নিজের নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে এ দিন বিকালে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দেখে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছেন অভ্যর্থনা জানাতে যাওয়া পাহাড়-সমতলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও! বিমানবন্দরে নেমে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই কিছু কথাবার্তা বলেছেন মমতা। বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের হাতের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলেছেন। তার পরে নিজেই এগিয়ে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁর আসার উদ্দেশ্য। মমতার কথায়, “অসমে যা হয়েছে, তা আমানবিক। এটা মানাই যায় না! ওখান থেকে আসা শরণার্থীদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তা আমরা দেখছি। আমি নিজে ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।” রাজনীতির রং ছাড়াই সকলকে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “টাকার দরকার নেই। সকলে শরণার্থীদের জন্য জিনিসপত্র প্রশাসনের হাতে দিলেই তা আমরা ওঁদের তুলে দেব।”

বন দফতর সূত্রের খবর, সন্ধ্যে ৫টা নাগাদ চাপড়ামারি বনবাংলোয় পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, আজ, শনিবার মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতমবাবু কুমারগ্রামে যাবেন। তাঁদের ট্রেনে ডুয়ার্সে পৌঁছনোর কথা। এনজেপি নেমে সড়ক পথেও যেতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী চাপড়ামারি থেকে কুমারগ্রাম ঘুরে বিকালে আবার বাগডোগরা থেকে কলকাতার উড়ান ধরবেন বলে সরকারি সূত্রের খবর।

যে বিজেপি-কে জমি ছাড়তে না চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এমন বিস্ময় সফর বলে মনে করা হচ্ছে, তারা আবার এ দিনই বাঁকুড়ায় তৃণমূলের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি ইঁদপুরে দাপিয়ে সভা করেছে! বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ওই সভায় যতটা তৃণমূলের বিরুদ্ধে গর্জেছেন, মঞ্চের নীচে আদিবাসীরাও শাসক দলের নেতা-কর্মীদের জীবনযাত্রা নিয়ে তত ক্ষোভ ঝরিয়েছেন। ভিড় দেখে রাহুলবাবু মঞ্চে উঠে বলেছেন, “এখানে তো পথসভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সভা যে কার্যত জনসভার রূপ নিয়েছে!”

বিপদ বুঝে মরিয়া হচ্ছে তৃণমূলও। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েকটি জেলাকে একসঙ্গে নিয়ে কর্মী সম্মেলনের পাশাপাশি জেলার নেতা ও বিধায়কদের সঙ্গে আলাদা করে মুখোমুখি বসতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। মমতারই নজরে এসেছে, দলের সদস্যকরণ অভিযান আশানুরূপ হচ্ছে না। ভোটার তালিকায় নতুন নাম তোলার প্রক্রিয়ায় দলীয় নেতা-বিধায়কেরা ঠিকমতো মনোযোগ দিচ্ছেন না। উল্টে দলত্যাগের হিড়িক বাড়ছেই। তাই জেলার বিধায়ক এবং কোর কমিটির সদস্যদের কলকাতায় ডেকে আলাদা করে আলোচনার নির্দেশ দিয়েছেন দলনেত্রী। ভার দেওয়া হয়েছে মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সীকে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “সদস্যকরণ অভিযান এবং দলের প্রতিষ্ঠা দিবসকে কেন্দ্র করে কিছু কর্মসূচি নিয়ে জেলাগুলির সঙ্গে আলাদা করে বসা হবে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE