সিভিক শাসনের আড়ালে রয়েছে শোষণও! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বেতন কম কিন্তু বেতের ওজন ভারী। তাতেই চলে ‘দাদাগিরি’। সিভিক ভলান্টিয়ারদের দাপট নিয়ে আমজনতার অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ড নতুন করে এই বাহিনীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ‘অস্বস্তি’ শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারেরও। সিভিক ভলান্টিয়ারদের সংগঠনের দাবি, রাজ্যে মোট সিভিক ভলান্টিয়ারের সংখ্যা এখন ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৬০। বেতন মাসে হাজার দশেক। কিন্তু উর্দির ‘জোরে’ অনেকেই নাকি বাড়তি রোজগার করে নেন। যদিও প্রকাশ্যে কেউই সে কথা স্বীকার করেন না। চালু থাকে সিভিক-শাসন।
চলতি বছরেই পুজোর বোনাস বেড়েছে সিভিকদের। বেড়েছে অবসরকালীন সুবিধাও। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই দু’বার আদালতে পশ্চিমবঙ্গে ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দু’টি আলাদা মামলায় এসেছে সিভিক ভলান্টিয়ার প্রসঙ্গ। আরও ‘অস্বস্তি’ বেড়েছে রাজ্য সরকারের। গত ৩ সেপ্টেম্বর। গত মার্চ মাসে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় চুক্তির ভিত্তিতে আদালতের কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজ্য। সেই মামলাতেই প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম বলেন, “সর্বত্র কী ভাবে চুক্তির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে? এমন জিনিস আমি আর কোথাও দেখিনি।” তিনি আরও বলেন, “এখানে পুলিশও চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়। দেশের কোথাও আমি এমন দেখিনি।”
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আরজি কর মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টেও প্রশ্ন ওঠে চিকিৎসকদের জন্য সাত দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘অস্থায়ী’ নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে। ‘রাত্তিরের সাথী’ বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘অভিযুক্ত পুলিশের একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। নিরাপত্তার জন্য সিভিক ভলান্টিয়ারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি তো? নিরাপত্তার অভাব ছিল বলেই তো ওই সিভিক ভলান্টিয়ার সারা হাসপাতাল ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার আপনারা নিরাপত্তার দায়িত্বে অস্থায়ী কর্মী রাখবেন?’’
আরজি কর-কাণ্ডের আগে হাওড়ার আমতায় ছাত্রনেতা আনিস খান হত্যাতেও নাম জড়িয়েছিল সিভিক ভলান্টিয়ারদের। রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও গোলমালের বহু অভিযোগ উঠেছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কারণ, সাধারণ ভাবে শাসকদলের স্থানীয় ‘দাদা’-র মনোনীতরাই এই কাজ পান। ফলে তাঁরা এলাকার পুলিশ আধিকারিকদেরও ‘স্নেহধন্য’।
অতীতে রাজ্য সরকারের কাজের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার মনে করেন, যত গোলমাল নিয়োগের অনিয়মেই। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘কিছু কিছু জরুরি পরিষেবা রয়েছে, সেখানে স্থায়ী নিয়োগই যথার্থ। তাই এঁদের নিয়োগ যদি সতর্কতার সঙ্গে হয়, তবে সমস্যা কম হবে।’’ একই কথা বিজেপির অর্থনীতিবিদ-বিধায়ক অশোক লাহিড়িরও। তিনি বলেন, ‘‘সকলকে দিয়ে সব কাজ হয় না। নিজের লোকেদের চাকরি দেওয়ার জন্যই এটা (সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ) করা। কিন্তু ডাক্তারের কাজ কমপাউন্ডারকে দিয়ে হয় না।’’ অশোক আরও মনে করেন, টাকা বাঁচানো এবং কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সরকার পরিষেবা দেওয়াটা বড় বিষয় নয় বলেই মনে করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এক ঢিলে দু’পাখি মারার চেষ্টা। কম মাইনেতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। চুক্তিভিত্তিক কাজের দায়বদ্ধতাও কম হয়।’’ অভিরূপের বক্তব্য, ‘‘সরকারের নীতি হল, বেশি লোককে কাজ দাও। স্থায়ী চাকরিতে আর্থিক দায়িত্ব অনেক বেশি। চাকরি জীবনের পরেও পেনশন দিতে হয়। এই সরকার এক জনের বেতনে তিন জনকে কাজ দিতে চায়। সরকারের দিক থেকে দেখলে তিনটে পরিবারে হাসি ফোটাচ্ছে অস্থায়ী নিয়োগ। এটা রিডিস্ট্রিবিউশন নীতি।’’
পুলিশকে ‘সহায়তা’ করার জন্য দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে হোমগার্ড নিয়োগ পদ্ধতি বহুকালের। কিন্তু তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সিভিক বাহিনী গড়লেন? অনেকেই অর্থের কথা বলেন। একজন হোমগার্ডের দৈনিক মজুরি ৫৬৫ টাকা। সেখানে সিভিকদের ৩১০ টাকা। হোমগার্ডদের নিয়োগপত্র, অবসরের সময়ের কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সিভিক ভলান্টিয়ার মানে ‘কাগজ’ ছাড়াই কাজ। আজ ‘না’ বললে কাল থেকেই চাকরি নেই।
খাতায়কলমে এই বাহিনী কোনও ভাবেই পুলিশের নয়। অথচ আমজনতা এদের ‘সিভিক পুলিশ’ নামেই চেনে। কলকাতা পুলিশের এক অফিসারের কথায়, ‘‘এদের সে ভাবে কোনও প্রশিক্ষণ হয় না। রাস্তায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণেও প্রশিক্ষণ লাগে। যেটা হোমগার্ডদের দেওয়া হয়।’’ ওই অফিসারের আরও দাবি, ‘‘অনেক সময়ে এদের তদন্তের কাজেও ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগও এসেছে। তবে সকলেই খারাপ নন।’’ তবে পুলিশের একাংশ এটাও মনে করে যে, একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে গেলে আইনকানুনের সামান্য পাঠ, নৈতিকতা, আচরণবিধি শেখানোও দরকার। তবে এই বাহিনীর অনেক সদস্যই যে নিজেদের আইনরক্ষকদের চেয়েও ঊর্ধ্বে মনে করেন, তা একান্ত আলোচনায় মেনে নেন বাহিনীর সদস্যদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আমাদের মধ্যে অনেকে নিজেকে পুলিশের ওসি মনে করেন। ডিজি, ডিআইজি মনে করেন, এমন লোকও রয়েছে। এদের জন্যই আমাদের ছোট করে দেখছে সমাজ।’’
আরজি কর-কাণ্ডের পরে সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্য কিছু ‘আচরণবিধি’ চালু হয়েছে। তবে এ সবে সিভিকদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলেই মনে করেন আইনজীবী কল্লোল বসু। তাঁর কথায়, ‘‘আইনি চোখে এই বাহিনী নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই। এদেরও জবাবদিহি করতে হয় না। কোনও কাঠামো নেই বাহিনীতে। থানার বড়বাবুকে খুশি রাখতে পারলেই হয়।’’ কল্লোল মনে করেন, ‘দায়’ না থাকার জন্যই বাঁধনহীন সিভিক ভলান্টিয়ারেরা। তিনি বলেন, ‘‘স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার তাঁবেদারদের এই চাকরিতে নিয়োগ করা হয়। এর ফলেই শৃঙ্খলাহীন প্রশাসন তৈরি হয়েছে।’’
‘রাজনৈতিক’ স্বার্থের প্রসঙ্গ সাধারণ মানুষও বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, সিভিকদের মাধ্যমে ‘ঝান্ডাতন্ত্র’ তৈরি করে রেখেছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল। ‘তোলাবাজি’ থেকে ভোট পরিচালনা পর্যন্ত যে কোনও কাজে লাগানো যায় এই বাহিনীকে। যদিও তা মানতে নারাজ তৃণমূলের আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এগুলো সব রাজনৈতিক কথা। কত হোমগার্ড তো বাম আমলে নিয়োগ হয়েছিলেন। তাঁরা এখনও কাজ করছেন। তাঁদের কি সিপিএমের হার্মাদবাহিনী বলা হবে?’’
প্রসঙ্গত, প্রথম বার ক্ষমতায় এসে এই বাহিনী তৈরি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ২০১৩ সালে রাজ্যে ৪০,০০০ পুলিশ এবং ১,৩০,০০০ হাজার ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের ১০ অক্টোবর কাজ শুরু করে ‘সিভিক ভলান্টিয়ার পুলিশ’। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর নাম থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’ করে রাজ্য। প্রথমে শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক থাকলেও এখন অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হলেই হয়। ওই বাহিনী গঠনের পরে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিক ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি হয়। তবে সিভিকরা খুব বেশি ‘সংগঠিত’ হতে পারেননি। ২০১৪ সালের ২২ জুন পর্যন্ত কাজের পরে পুনর্নবীকরণ বন্ধ ছিল। সে বছরের ১০ জুলাই রানি রাসমণি রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ওই সংগঠন। তখন অনেককে সাসপেন্ডও করা হয়। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই সংগঠনের এক পদাধিকারী বলেন, ‘‘আমাদের সকলেই খারাপ, তা কেউ বলতে পারবেন না। কারও কারও জন্য সকলের নাম খারাপ হয়।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘অনেক দাবি করেও আমরা কাগজ পাইনি। আমাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ হয় না। বিভিন্ন খাত থেকে টাকা নিয়ে অনিয়মিত দিনে বেতন দেওয়া হয়।’’ ওই সংগঠনকের আরও দাবি, ‘‘আমাদের দিয়ে এত কাজ তো করানোর কথা নয়। যানবাহন নিয়ন্ত্রণ বা মেলায় ভিড় সামলানো আমাদের কাজ। কিন্তু থানার বড়বাবুর বাজার করা, তাঁর মেয়েকে স্কুলে পৌঁছনো থেকে যাবতীয় অপকর্মের দায়ভাগী হই আমরা। (রাজনীতির) দাদাদের কাজও করতে হয়। এটা তো এক ধরনের শোষণ! আমাদের মধ্যে অনেকে এমএ পাশও আছেন। অন্য চাকরি নেই বলে এমন শোষণ কি ঠিক?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy