একটা দীর্ঘ সময় ধরে সারা বাংলার বুথস্তরের ‘নিখুঁত’ নির্বাচনী তথ্য পেতে সিপিএমই ছিল যে কারও ভরসা। ২০১১ সালের পর থেকে সব ছন্নছাড়া। কারণ, লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে নিচুতলার সংগঠন। গত দেড় দশকের তথ্য ‘পুনরুদ্ধার’ করে এ বার সেই বুথস্তরের সংগঠনই নতুন করে গোছানোর কাজ শুরু করতে চাইছে ১৪ বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত দল। এবং এই তথ্য গোছানোর, বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিবিদদের সাহায্যে।
দুর্বলতার আসল ‘ভূত’ যে লুকিয়ে রয়েছে বুথস্তরেই, তা সিপিএম নেতারা অনেক দিন ধরেই জানেন, মানেনও। দলীয় স্তরে একাধিক বার বুথ সংগঠন জোরদার করার নির্দেশ দেওয়ার পরেও কার্যকর হয়নি। এ বার বুথে দুর্বলতার ‘ভূত’ তাড়াতে নতুন পরিকল্পনা নিল রাজ্য সিপিএম। পাশাপাশি, বুথস্তরে কমিটি গড়ার জন্য সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হল রাজ্য সম্মেলন থেকে।
সোমবার সিপিএম রাজ্য সম্মেলনের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয়ার্ধে বসেছিল বিশেষ অধিবেশন। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আগেই জানিয়েছিলেন, এমন অধিবেশন এ বারই প্রথম হচ্ছে। সিপিএম সূত্রে খবর, সেখানেই বলা হয়েছে, বিধানসভাভিত্তিক প্রতিটি বুথের গত ১৫ বছরের ফলাফল পর্যালোচনা করবে দল। ১৫ বছর আগে সংশ্লিষ্ট বুথে কত ভোট ছিল, কী ভাবে তা কমেছে, ভোট কমে এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়েছে এবং সর্বোপরি বামেদের ভোট কমে কাদের ভোট কতটা বেড়েছে— এই সবই বিশ্লেষণ করবে সিপিএম।
আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলা না হলেও সিপিএমের একাধিক নেতা একান্ত আলোচনায় মানছেন, এই পরিসংখ্যান নিয়ে বিশেষজ্ঞদেরই কাজ করতে হবে। কয়েক মাস আগে সেলিম সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিলেন— তাঁরা ডেটা অ্যানালিস্ট, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো বিভিন্ন বিষয়ে লোক খুঁজছেন। সূত্রের খবর, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে সেই দল কাজও করতে শুরু করেছে। গ্রামাঞ্চলে এই মুহূর্তে পার্টিকে কী ভাবে কাজ এগোতে হবে, সোমবার তা নিয়ে একটি ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন’ দেখানো হয়েছে বিশেষ অধিবেশনে। এটি দেখে অনেকেই মনে করছেন, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের বিশ্লেষণকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। দলের অনেকেরই ধারণা, গত দেড় দশকের বুথভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের জন্য তুলনামূলক ‘উর্বর’ আসন চিহ্নিত করতে চাইছে সিপিএম। দলের তরফে বলা হয়েছে, প্রতিটি বুথ এলাকায় জুন মাসের মধ্যে বুথ কমিটি গঠন শেষ করতে হবে। এ বিষয়ে সর্বস্তরের নেতৃত্বকে দায়বদ্ধতা দেখানোর কথাও বলা হয়েছে অধিবেশনে।
সোমবার সেলিমের পেশ করা প্রতিবেদনের উপর প্রতিনিধিদের আলোচনা শেষ হয়। সেই আলোচনার নির্যাস সম্পর্কে সেলিম বলেছেন, ‘‘প্রতিনিধিদের আলোচনায় নাছোড়বান্দা মনোভাবের কথা উঠে এসেছে।’’ এ প্রসঙ্গে কোনও বাড়তি ব্যাখ্যা দেননি সিপিএম রাজ্য সম্পাদক। তবে দলের নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ঘটনায় তাঁদের গণসংগঠনগুলি আন্দোলনের তেজ দেখালেও তা ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়নি। আন্দোলন শুরু হলেও ‘শেষ’ হয়নি, তা-ও মানছেন সিপিএম নেতারা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক এ-ও বলেছেন, ‘‘আমরা ঠিক করেছি প্রজেক্ট বেস্ড মিশন মোডে আন্দোলনকে নিয়ে যাব।’’ ‘মিশন মোড’-এর অর্থ, কোনও কিছু শুরু করলে তার শেষ পর্যন্ত যাওয়া। সেই প্রশ্নে দুর্বলতা কাটানোর কথাই প্রকারান্তরে উল্লেখ করেছেন সেলিম।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে ‘ইয়েসম্যান’ প্রসঙ্গও। অভিযোগ উঠেছে, মধ্যস্তরের একাংশের নেতা আরও বড় নেতার ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ মেলাচ্ছেন। বলা হয়েছে, অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে নেতাদের ঘনিষ্ঠ হওযার মানদণ্ডেই কেউ কেউ নেতা হয়ে উঠছেন। দক্ষিণবঙ্গের এক প্রতিনিধি বলেছেন, দলের কমিটিতে কেউ একবার জায়গা পেলে তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হচ্ছে। যে প্রবণতা বিপজ্জনক।
সম্মেলনের শেষ লগ্নে পলিটব্যুরোর তরফে ‘পর্যবেক্ষণ বক্তৃতা’ করেন প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার নতুন কমিটি গঠন হবে। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে বেশ কয়েক জন নেতা বয়সের কারণে বাদ পড়বেন। তাঁদের জায়গায় কারা আসেন তা নিয়ে দলের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে।
তবে কে কমিটিতে এলেন বা কে বাদ পড়লেন, সিপিএমে তার চেয়েও বেশি শিরঃপীড়া এখন একটাই, বুথের ‘ভূত’। সিপিএমের প্রয়াত এক রাজ্য সম্পাদক গর্ব করে বলতেন, রাজ্যের কোন পাড়ায় কার বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হচ্ছে আর কার বাড়িতে মৌরলা মাছ, তা-ও আমাদের কর্মীরা জানেন। ঘটনাচক্রে, তখন পাওয়ার পয়েন্টের যুগ আসেনি। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার বিশ্লেষণে সিপিএমের ‘পাওয়ার’ কি ২০২৬-এ বাড়বে? সিপিএমের এক নেতার উত্তর, ‘‘ছাব্বিশ না-হোক ছত্রিশ, যা সত্য তা ফিরে আসবেই।’’