জয়া মিত্রের ‘নির্জলা ভবিষ্যতের দিকে’ (১৭-৩) প্রবন্ধটি সময়োচিত। আজ শুধু এ দেশে নয়, সারা বিশ্বে পানীয় জলের সঙ্কট দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। বিশেষত আমাদের দেশে তথা রাজ্যে পানীয় জলের অবস্থা ভয়াবহ। গ্রীষ্ম পড়তে না পড়তেই প্রতি বছরের মতো এ বছরেও পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে। নদী, নালা, খাল, বিল সব শুকিয়ে যেতে বসেছে। নদী বা বড় জলাধার থেকে পাম্প করে ঘরে ঘরে নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প ‘সজলধারা’ আজ জলের অভাবে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর কারণ মূলত দীর্ঘ দিন ধরে জলাশয়গুলিকে সংস্কার না করা এবং নির্বিচারে জল উত্তোলন। আশঙ্কা, আগামী দিনে সেগুলি শুকিয়ে ডাঙায় পরিণত হবে। ছোটবেলায় দেখতাম, টানা বৃষ্টির সময় অর্থাৎ বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে গেলে জলকাদায় হাঁটতে হত। এমনকি শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে কর্দমাক্ত রাস্তাগুলির বিভিন্ন জায়গায় বুদবুদ করে উপরে জল উঠত। নদীর দু’কূল বেয়েই শুধু জল বইত না, খাল, বিল, পুকুর এমনকি বাড়ির কুয়োগুলি পর্যন্ত জলে টইটম্বুর হয়ে থাকত। এখন সে সব স্বপ্ন। গ্রাম ও শহরের রাস্তাঘাট, কুয়ো, কলতলা সব কংক্রিট হওয়ার ফলে বর্ষার জল সঞ্চিত হয়ে মাটির তলায় যেতে না পেরে যত্রতত্র বয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, বর্ষায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণের চেয়ে, জল অপচয়ের মাত্ৰা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে।
সরকারের পানীয় জল সংরক্ষণ ‘জল ধরো, জল ভরো’ পরিকল্পনাটি আজ সরকারের উদাসীনতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। জল ধরে রাখার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে মাটি কেটে যে ছোট জলাশয়গুলি তৈরি করা হচ্ছে, কিংবা জল সঞ্চয়ের জন্য যে ‘চেক ড্যাম’ তৈরি করা হচ্ছে, তা এতটাই নিম্নমানের এবং জলধারণের ক্ষমতা তাতে এতই কম যে, মানুষ, পশু, পাখির পানীয় জল অথবা চাষাবাদের কাজে ব্যবহারের পর সেগুলি দ্রুত শুকিয়ে ডাঙায় পরিণত হচ্ছে।
তবে এখনও সময় আছে, রাজ্য প্রশাসন যদি জল সরবরাহের বড় জলাশয়গুলির সারা বছর সংস্কার ও পরিচর্যা করে, পরিত্যক্ত জলভূমিগুলি বুজিয়ে ‘বিল্ডিং’ না বানিয়ে, আগামী দিনের পানীয় জলের উৎসের জন্য সংস্কার করে এবং গ্রাম ও শহরের বহু পুরনো অব্যবহৃত কুয়োগুলির পরিচর্যা করে পানীয় জল সঞ্চয়ের জন্য ব্যবহার করে, তা হলে পরবর্তী কালে রাজ্যে পানীয় জলের সমস্যা কিছুটা মিটতে পারে। এ ছাড়া চাষ-আবাদ, শিল্প, কলকারখানা থেকে শুরু করে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে জলের ব্যবহারে যেন অযথা ‘অপচয়’ না ঘটে, সে ব্যাপারে সরকারকে কড়া নজর রাখতে হবে এবং জনগণকে এই অপচয় রোধ করতে সজাগ ও সচেতন হতে হবে। নয়তো এই পানীয় জলের অভাবই হবে গৃহযুদ্ধের মূল কারণ!
তপন কুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
অ-সচেতন
জয়া মিত্র ধারাবাহিক ভাবে জলবিহীন, নিকট-ভবিষ্যতের জলসঙ্কট সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো লিখছেন। ‘নির্জলা ভবিষ্যতের দিকে’ প্রবন্ধেও সেই ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু, আমাদের সচেতনতা কোথায়? উন্নয়নের জোয়ারে শতাব্দীপ্রাচীন বৃক্ষরাজি উৎপাটিত হয়েছে। ঝাঁ-চকচকে ফোর লেন-সিক্স লেন-এইট লেন বিশিষ্ট হাইওয়ে দিয়ে আনন্দ-ভ্রমণে ছুটছেন নাগরিক। কংক্রিটের ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় চোখেও পড়ে না, নীচ দিয়ে বইছে ক্ষুদ্রকায়া একটি নদী, যার খাত থেকে উত্তোলিত হয়ে চলেছে নির্বিচারে পাথর, বালি।
শিলিগুড়ি শহর উত্তরবঙ্গের অলিখিত রাজধানী। যার মাঝখান দিয়ে বইছে মহানন্দা নদী। দিনকয়েক আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নদীর এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে পাকাপোক্ত বাড়ি, স্কুল, গরু-মোষের বিচরণ ক্ষেত্র। সব কিছু নিয়ম মেনে নির্মিত? নদীর বুকে মানুষের এমন রাজপাট চলতে পারে? মুছে দেওয়া যেতে পারে নদীর অস্তিত্ব? সেবক ছাড়ালেই দেখা যাবে ত্রিস্রোতা বা আমাদের বহু পরিচিত তিস্তা নদীকে। দু’কূল জুড়ে বালি-পাথরের চড়া, বর্ষায় জলের তোড়ে বার বার ছারখার হয়ে যায় জনপদ, তবু একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ চালু রয়েছে। পাহাড় কেটে তৈরি হল সেবক-রংপো রেলপথ। অবশ্যই নব্য পর্যটন দ্রষ্টব্য হতে যাচ্ছে এই রেলপথ। কিন্তু, হিমালয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোনও বিপদ আড়ালে মুচকি হাসছে না তো? এগিয়ে চলা যাক। পর পর দেখা মিলবে লিস, ঘিস, চেল, ডায়না, মাল, মূর্তি, জলঢাকা, জয়ন্তী নদীর। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে এসেছে তোর্সা, জলঢাকা, ডায়না। বরফ গলা জলে পুষ্ট বলে তাদের বুকে জল থাকে সারা বছর। বাকিরা বৃষ্টির জলে পুষ্ট। মাল নদীতে হড়পা বানে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বিষাদ-স্মৃতি এখনও টাটকা। তবু, সচেতনতা কোথায়? মূর্তি নদীকে ঘিরে রিসর্টে ছয়লাপ এলাকা।
এক-একটি শহুরে বাড়িতে, বিশাল আবাসনে যে পরিমাণ জল অপচয় হয়, তাতে আমাদের খেদ নেই। কারণ, ট্যাক্স তো দিচ্ছি! অতএব, কে শুনবে কার নির্দেশ? তাই সর্বত্র, বিশেষত শহরাঞ্চলে জলের মিটার বসানো ভীষণ প্রয়োজন। তাতে কমতে পারে জলের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রবণতা। আন্দোলন হবে? হোক। অন্তত এই বোধটা জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন, জলসঙ্কট ঘনীভূত। চূড়ান্ত অবহেলায় এখনও পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তার ধারে পুরসভার জল বয়ে যায় কল বেয়ে। আমরা এতটাই উদাসীন, দেখেও সেই কলগুলো বন্ধ করি না। আবার নির্বিচারে জলের কলগুলো চুরি হয়ে যায়। আমাদের অজ্ঞানতা, নির্বুদ্ধিতা, বা অতি চালাকির কারণে গরম না পড়তেই বিভিন্ন স্থানে জলাভাব দেখা দিয়েছে। পুরসভার অধীন অঞ্চলগুলোতে জল আসছে না বা রাস্তার কলগুলোর জলসঙ্কট জানান দিচ্ছে, বিপদ আসন্ন। তবু, ‘ভূগর্ভে জল পৌঁছনো’ এবং অবাধে জল উত্তোলনের বিষয়ে সচেতনতা কোথায়?
‘নির্জলা ভবিষ্যৎ’-এর কথা ভাবতে বয়ে গেছে আমাদের। তীব্র দহন-জ্বালা জুড়োতে একটা ছাতা নিয়ে নিচ্ছি, বাইরে বেরোনোর আগে সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করছি, ডাব বা ঠান্ডা পানীয় সেবন করে, অফিসে-বাড়িতে শীতাতপ যন্ত্রের নীচে অবস্থান করেই আমরা ‘ঠান্ডা’ আবহাওয়া উপভোগ করছি। আর কী চাই?
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
লোভসর্বস্ব
আজ আমরা এতটাই উন্নয়ন প্রিয় হয়েছি যে, জল, যার থেকে জীবনের সৃষ্টি, যে জল জীবনের ধারক এবং বাহক, সেটিকে অবহেলা করে চলেছি। এর পরিণাম আশঙ্কাজনক, যদি না এই বোধ আমাদের জাগে যে, জল অফুরান নয়। প্রাকৃতিক জলচক্রের নিয়ম মেনেই জলের ব্যবহার করতে হবে আমাদের, অন্যথা বিপর্যয়। আজ আমরা সভ্যতা ও আধুনিকতার অন্ধ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে যদি প্রাকৃতিক অবলম্বনগুলিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামি, শেষের সে দিন এগিয়ে আসবে আরও। এখনও সময় আছে এটি উপলব্ধি করার যে, প্রকৃতিতে সকল প্রাণের জীবন ধারণ ও সুষ্ঠু যাপনের জন্য পর্যাপ্ত উপাদান মজুত আছে। কিন্তু মানুষের লোভের কাছে তা যথেষ্ট নয়।
তাপস কুমার বিশ্বাস, কলকাতা-১২০
জলের পাত্র
গরমকাল শুরু হয়ে গিয়েছে। মানুষ তো বটেই, অসহনীয় গরমে পশুপাখিরাও ভীষণ কষ্ট পায়। বিশেষত ছোট পাখিগুলি জলের অভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। তাই আমার অনুরোধ, আমরা সবাই বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় ছোট পাত্রে একটু জল রাখি। একটি সাধারণ মাটির পাত্র বা অন্য কোনও অগভীর পাত্রে জল ভরে রাখলে পাখিরা সহজেই সেখান থেকে জল পান করে তৃষ্ণা মেটাতে পারবে। সামান্য উদ্যোগ অনেক পাখির জীবন বাঁচাতে পারে।
নাজিবুল হক, তিলুটিয়া, বীরভূম
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)