আক্রান্তকে নিয়ে হাসপাতালে হাবিব-রহিম। ছবি: নির্মল বসু।
আপ-ডাউন দুই ট্রেনের লাইনের মাঝে পাথরের উপরে পড়েছিলেন ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত মহিলা। দেহে সাড় নেই। শুধু নিঃশ্বাসটুকুই পড়ছিল।
মঙ্গলবার সকাল তখন প্রায় ৮টা। উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ-শিয়ালদহ শাখার হাড়োয়া-ভাসিলিয়া স্টেশনের মাঝে দেগঙ্গার কুমরুলি গ্রামের কাছে এই দৃশ্য দেখতে পান স্থানীয় দুই যুবক হাবিব সর্দার এবং আব্দুল রহিম মণ্ডল। সকালে কাজে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। একজন ঢালাই মিস্ত্রি, অন্যজন চালকলে কাজ করেন।
এই অবস্থায় কী করা উচিত, প্রথমে তা ঠিক করতে পারেননি দুই যুবক। হাবিব বলেন, ‘‘প্রথমে মনে হয়েছিল, পুলিশে খবর দিয়ে দায় সারি। কিন্তু পরে মনে হল, মহিলাকে বাঁচাতে হবে। থানা-পুলিশ করতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে।’’ হাবিব এবং রহিমের রোজগার যৎসামান্য। যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার টানতেই হিমসিম খেতে হয়। কিন্তু তাতেও দমে যাননি তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘টাকার কথা ভাবিনি, শুধু মহিলার প্রাণের কথাটাই ভেবেছি।’’
নিজেদের কাছে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা টাকা ছিল, তা দিয়েই একটা গাড়ি ডাকতে ছোটেন দু’জন। তাঁদের কথায়, ‘‘কোনও গাড়িওয়ালাই রক্তাক্ত মহিলাকে তুলতে রাজি হচ্ছিলেন না। সবাই বলতে থাকেন, এ সব পুলিশি কেসে না জড়ানোই ভাল।’’ শেষমেশ, ধরে-করে ১২০ টাকায় রফা হয় এক অটোওয়ালার সঙ্গে। জখম মহিলাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাড়োয়া হাসপাতালে। সেখান থেকে পরে পাঠানো হয় বারাসত জেলা হাসপাতালে।
কী ভাবে জখম হলেন বছর বত্রিশের ওই মহিলা?
রেল পুলিশের কাছে মহিলা কোনও রকমে জানিয়েছেন, সোমবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ বসিরহাট থেকে ডাউন হাসনাবাদ-শিয়ালদহ লোকালে উঠেছিলেন। শীতের রাতে সাধারণ কামরায় লোকজন কমই ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কামরা পুরো খালি হয়ে যায়। শুধু বসেছিল দুই যুবক। মহিলার দাবি, ওই দুই যুবক অনেকক্ষণ থেকে তাঁকে ইশারা করছিল। কামরা খালি হতেই উড়ে আসে নানা কুপ্রস্তাব। মহিলা বলেন, ‘‘হাত ধরে টানাটানি শুরু করে ওরা। আমি ভয় পেয়ে যাই। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’’ মহিলার দাবি, বিপদ বুঝে ফোন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতীরা। তিনি চিৎকার শুরু করলে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।
বারাসত হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মহিলার শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত। মাথা ফেটেছে। পায়েও চোট লেগেছে। তবে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। মহিলার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পূর্ব রেলের কর্তারা।
তবে এই ঘটনায় লোকাল ট্রেনে যাত্রী সুরক্ষার হাল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিত্যযাত্রীদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা, দিনে যদি বা ট্রেনের কামরায় রেলপুলিশকে কখনও-সখনও দেখা যায়, রাতের দিকে কাউকে তেমন চোখে পড়ে না। প্রতি ট্রেনে, বিশেষত রাতের দিকে পুলিশ কর্মী থাকা বাধ্যতামূলক বলে মানছেন রেলের কর্তারাও। সোমবার ওই ট্রেনেও পুলিশ ছিল বলেই দাবি রেল পুলিশের। কত জন পুলিশকর্মী ছিল, তাঁদের ভূমিকা কী ছিল, সে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেল আধিকারিকেরা।
মহিলার বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরে। মঙ্গলবার বারাসত হাসপাতালে এসে তাঁর দাদা জানান, রবিবার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল বোন। তারপরে আর ফেরেনি। মহিলা রেল পুলিশকে জানিয়েছেন, বসিরহাটে কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন। তবে রাতে কোথায় ছিলেন, কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তা নিয়ে রেলপুলিশের কাছে মুখ খুলতে চাননি তিনি। মহিলার কথায় কিছু অসঙ্গতি আছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। সব দিক খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। তবে ঘটনা যা-ই হোক, হাবিব-রহিমরা তড়িঘড়ি মহিলাকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মহিলা প্রাণে বাঁচতেন না, তা মানছেন রেল পুলিশের কর্তারাও। এক অফিসার বলেন, ‘‘মানুষের অনেক ভুল ধারণা আছে। এ সব ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কোনও অবস্থাতেই উদ্ধারকারীদের হেনস্থা করা যাবে না। এমনকী, তাঁরা চাইলে নিজেদের পরিচয়ও গোপন রাখতে পারেন।’’
মহিলার প্রাণ বাঁচিয়ে অবশ্য বিরাট কাজ করেছেন বলে মনে করছেন না হাবিব-রহিমরা। তাঁদের কথায়, ‘‘একজন মানুষ এ ভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে মরবে, দেখেও দেখব না, এমনটা হয় নাকি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy