Advertisement
E-Paper

পঞ্চায়েত ভোটের পরে এ বার লক্ষ্মীর ভান্ডার, দলকে কেন বার বার অস্বস্তিতে ফেলছেন হুমায়ুন কবীর? প্রশ্ন তৃণমূলে

সাচার কমিটির রিপোর্ট সিপিএমের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছিল। হুমায়ুন কবীর নিজে সংখ্যালঘু। তাঁর বক্তব্যের অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তৃণমূলের অনেকে।

TMC in irony on MLA Humayun Kabir\\\'s question regarding Lakshmi Bhandar

হুমায়ুন কবীর। — ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৩ ১৭:৪৫
Share
Save

দিন কুড়ির মধ্যে দ্বিতীয় বার দলকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন ডেবরার তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন আইপিএস হুমায়ুন কবীর। এর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তপাত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নিজের ‘হতাশা’ এবং ‘লজ্জা’ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। আর শুক্রবার খাস বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে আরও একবার বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন শাসকদলকে। পরিস্থিতি ‘বেগতিক’ বুঝে, অধিবেশন থেকে বাইরে বেরিয়েই অবশ্য সুর বদলে ফেলেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন। তৃণমূল তড়িঘড়ি কিছু নির্দেশও পাঠিয়েছে তাঁকে। কিন্তু দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কেন হুমায়ুন এমন কাজ করছেন? মন্ত্রিত্ব হারানো বিধায়ক কি নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চাইছেন? দলকে চাপে রাখতে চাইছেন? না কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য?

শুক্রবার হুমায়ুন বিধানসভায় বলতে শুরু করার পরই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করে দিয়েছিলেন শাসকদলের মন্ত্রী-বিধায়কেরা। কিন্তু তিনি থামেননি। ‘প্রতীচী’ ট্রাস্টের একটি রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘তফসিলি জাতি এবং জনজাতি মহিলাদের মতো মুসলমান মহিলাদের লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে হাজার টাকা দেওয়া হবে কি?’’ একই সঙ্গে বলেন, ‘‘মুসলমান মহিলাদের অবস্থা আর্থিক ভাবে ভাল না। আমরা যখন পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গিয়েছিলাম, তখন ওই ধরনের (মুসলমান) মহিলারা বলছিলেন, আমরা তো ভোট দিই। আমরা পাঁচশো টাকা পাচ্ছি, ওরা (তফসিলি জাতি ও তফশিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের মহিলারা) হাজার টাকা পাচ্ছে।’’

হুমায়ুন এ কথা বলার পরেই বিধানসভায় শোরগোল পড়ে যায়। মন্ত্রী শশী পাঁজা হুমায়ুনকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানোর চেষ্টা করেন। আর অধিবেশন কক্ষ থেকে বার হওয়ার পরেই হুমায়ুনকে কার্যত ঘিরে ধরেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ এবং উপ-মুখ্য সচেতক তাপস রায়। সূত্রের খবর, হুমায়ুনকে অরূপ বলেন, ‘‘তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ, আমাদের বিধায়ক, তুমি এই রকম একটা আলটপকা প্রশ্ন তুলে দিলে?’’ শাসকদল সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে, হুমায়ুন অরূপের প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি। কিছুটা আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করেন, তিনি তেমন কিছু বলতে চাননি। এর পর অরূপ মুখ্য সচেতক নির্মলের কাছে জানতে চান, এ ব্যাপারে হুমায়ুন আগে কিছু জানিয়েছিলেন কি না। কিন্তু পানিহাটির বিধায়ক নির্মল স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অধিবেশন কক্ষে হুমায়ুন নিজের ইচ্ছা মতোই প্রশ্ন তুলেছেন। আগে থেকে জানিয়ে এটা করেননি।

কেন করেননি? দীর্ঘ দিন প্রশাসনিক উচ্চ পদে থেকে দায়িত্ব সামলানো হুমায়ুনের শৃঙ্খলাজ্ঞান পরিষ্কার থাকারই কথা। তবে কি এই ভাবে আসলে তিনি দলকে কিছু বার্তা দিতে চাইছেন? দলের বাইরেও কি বার্তা রাখতে চাইছেন কিছু। চাইলে, কী সেই বার্তা? প্রশ্ন উঠছে এখানেই।

হুমায়ুন গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় তৃণমূলের প্রার্থী হন। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন আর এক প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষ। হুমায়ুন ভারতীকে হারান এবং মমতার তৃতীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় জায়গা পান। মেয়াদ যদিও বেশি দিন ছিল না। কিছু ব্যক্তিগত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তাঁকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয় বলে তৃণমূলের অন্দরে খবর। এর আনুষ্ঠানিক কোনও সত্যতা অবশ্য কখনওই পাওয়া যায়নি।

অনেকের মতে, অবসরের মাস চারেক আগে চাকরি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান এবং ভোটে লড়ার পিছনে তাঁর একটি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। মন্ত্রিত্ব পেয়ে সেই প্রত্যাশা বাড়ে। কিন্তু দ্রুতই মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়া, এবং দলের ভিতরেও তেমন গুরুত্ব না-পাওয়ায় তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে থাকতেই পারেন। তারই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে এই ধরনের ‘আলটপকা’ মন্তব্য। এ রাজ্যের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। সব রাজনৈতিক দলই তা বিলক্ষণ জানে এবং ভোটে তার হিসাব কষে। হুমায়ুন নিজে সংখ্যালঘু। দলের অন্দরে বা দলনেত্রীর কাছে তিনি কি সেই সংখ্যালঘু পরিচয়ের কোনও ‘অ্যাডভান্টেজ’ নিয়ে চাপ তৈরি করতে চাইছেন? এ প্রশ্নও কেউ কেউ করছেন।

হুমায়ুন অবশ্য শুক্রবার বিধানসভার অধিবেশন থেকে বেরিয়েই নিজের সুর বদলে ফেলেছেন। সাংবাদিকরা ঘিরে ধরতেই তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই মা লক্ষ্মী রূপে লক্ষ্মীর ভান্ডার দিচ্ছেন। এটি একটি মাইলফলক প্রকল্প। আমি এটাই বলতে চেয়েছি।’’ কিন্তু যা ‘বলতে চেয়েছিলেন’ হুমায়ুন, আর অধিবেশনে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন বা বলে ফেলেছেন, তার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা শাসকদলের নেতারা মানছেন। এবং বিরোধীরা এটাকে ‘ফুলটস’ বল হিসাবেই দেখছেন। ভগবানপুরের বিজেপি বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ মাইতি তো হুমায়ুনের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থনই জানিয়ে ফেললেন। অধিবেশনে তিনি বলেন, “তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুনবাবু বিধানসভায় যে দাবি তুলেছেন তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি এই সরকার বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করছে এবং তাদের উন্নয়ন সরকার পক্ষ নিজেই চায় না। তাই যে-প্রস্তাব তিনি সদনে তুলে ধরেছেন, সেই প্রস্তাব যদি এই সরকার মেনে না-নেয়, তা হলে সংখ্যালঘুদের কাছে এই সরকারের আসল রূপ প্রকাশ পেয়ে যাবে। এবং তাদের যে কেবল ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা প্রমাণ হয়ে যাবে।”

বাম আমলে মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে সাচার কমিটির রিপোর্ট আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এমনকি দলের অনেক সংখ্যালঘু নেতাও অভ্যন্তরে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সরকারের ভূমিকা নিয়ে। তাঁরা কার্যত মান্যতাও দিয়েছিলেন সাচার কমিটির রিপোর্টকে। যা সিপিএমের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়েছিল। হুমায়ুন নিজে সংখ্যালঘু। তাঁর এ হেন বক্তব্যের অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তৃণমূলের অনেকে। শুক্রবার এই সব কাণ্ড ঘটার পর দ্বিতীয়ার্ধের অধিবেশনে আর দেখা যায়নি হুমায়ুনকে। তিনি বেরিয়ে যান বিধানসভা থেকে। ইতিমধ্যেই দলের তরফ থেকে তাঁকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, বিধানসভার ভিতরেই হোক বা বাইরে, কোনও বক্তব্য রাখতে গেলে তাঁকে দলের অনুমতি নিতে হবে। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে তাঁর বক্তব্য আগে জানাতে হবে। দলের অনুমোদন পেলে তবেই তিনি তা বাইরে বলতে পারবেন। এই নির্দেশ হুমায়ুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন কি না সেটা শাসকদল যেমন নজরে রাখবে, নজরে রাখবে বিরোধীরাও।

Humayun kabir TMC TMC MLA Laxmi Bhandar Scheme

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}