আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অনুপস্থিতিতে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পার্থের বেহালা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ১০টি ওয়ার্ডে নতুন সভাপতিদের নাম ঘোষণা করেছেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। উল্লেখযোগ্য ভাবে সেই তালিকায় গুরুত্ব পেয়েছেন নিলম্বিত (সাসপেন্ডেড) বিধায়ক পার্থের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতরা। যে তিনটি ওয়ার্ডের সভাপতিদের বহাল রাখা হয়েছে, তাঁরাও বেহালার রাজনীতিতে ‘পার্থ অনুগামী’ বলেই পরিচিত।
তবে দীর্ঘ দিন ধরে পার্থ জেলবন্দি এবং রাজনীতি থেকে বহু দূরে থাকায় তাঁর ‘অনুগামী’ এখন কেউ রয়েছেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, যে কোনও অবামপন্থী দলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের বদলের সঙ্গে সঙ্গেই আনুগত্যেরও বদল হয়ে যায়। নতুন সভাপতিদের সম্পর্কে বেহালা পশ্চিমের এক তৃণমূল নেতা যেমন বলেছেন, ‘‘আগামী বছরে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে নতুন সভাপতিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাঁচ বারের বিধায়ক। তাই যাঁদের সভাপতি করা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে যে পার্থের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ ছিল, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এটুকু বলা যায় যে, সকলে এখন অতীত ভুলে আগামীর দিকে এগিয়ে যেতে চাইছেন। তাই পার্থ-অধ্যায় পিছনে ফেলে এই সভাপতিরা দলের মূলস্রোতের সঙ্গেই চলবেন।’’
১১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতিপদে থেকে গিয়েছেন অঞ্জন চক্রবর্তী। যিনি ‘পার্থ অনুগামী’ বলেই পরিচিত ছিলেন। ১১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি বদল করা হয়েছে। দু’দশকের বেশি সময় ওই ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন কাউন্সিলর অশোকা মণ্ডলের স্বামী অশোক মণ্ডল। কাউন্সিলর অশোকা একসময়ে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন। সেই সুবাদে ১১৯ নম্বর ওয়ার্ডে অশোকের দাপট ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে অশোকা পুরভোটে টিকিট না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আধিপত্য কমতে থাকে অশোকের। এখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাই বিকল্প হিসাবে সভাপতির দায়িত্বে আনা হয়েছে প্রবীণ অংশুকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর নাম ঘোষণার পরে বেহালা পশ্চিমের কর্মীমহলে প্রশ্ন উঠেছে সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে। তবে দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ওই নিয়োগের ক্ষেত্রেও অংশুকুমারের ‘পার্থ ঘনিষ্ঠতা’ই মাথায় রেখেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
১২৫ নম্বর ওয়ার্ডের দীর্ঘ দিনের সভাপতি ছিলেন মমতার ‘ঘনিষ্ঠ’ মিহির বসাক। বয়স ও অসুস্থতার কারণে মিহিরকে সভাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব পেয়েছেন বিশ্বজিৎ অধিকারী। তাঁকেও বেহালা পশ্চিমের রাজনীতিতে ‘পার্থ ঘনিষ্ঠ’ বলেই ধরা হয়। ১২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত কাউন্সিলর শিপ্রা ঘটক। তাঁর প্রয়াণের পর থেকে ওই ওয়ার্ডের সভাপতিপদটি শূন্য ছিল। এ বার সেই দায়িত্বে আনা হয়েছে পার্থর নেতৃত্বে যুব সংগঠন থেকে উঠে আসা সুদীপ রায়কে। ১২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সভাপতিপদে রেখে দেওয়া হয়েছে উৎপল দত্তকে, যিনি বেহালা পশ্চিমের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ‘পার্থ ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেই পরিচিত। ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রাক্তন মন্ত্রীর একদা ছায়াসঙ্গী তথা বিশ্বস্ত পার্থ সরকার (ভজা)। সূত্রের খবর, ভজার ‘অনুমোদন’ নিয়ে সভাপতি করা হয়েছে সঞ্জীব রাজকে। ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সভাপতিপদে রেখে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘ দিনের ‘পার্থ ঘনিষ্ঠ’ অভিজিৎ দে-কে। গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের কাউন্সিলর সঞ্চিতা মিত্রের তুলনায় অভিজিৎকেই বেশি ভরসা করতেন পার্থ।
অনেকেই এই সভাপতিদের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্থের ‘স্নেহধন্য’ কাউন্সিলর ভজার ভূমিকা দেখছেন। পার্থের জেলযাত্রার পর তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন ভজা। ১১৮, ১২৫, ১২৬ এবং ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডে যাঁদের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা বেহালা পশ্চিমের রাজনীতিতে ভজার সঙ্গেই রয়েছেন বলে জানাচ্ছেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে ভজার ভূমিকা অনেকটা রামায়ণের ভরতের মতো। ভোটের আগে পার্থদা জামিন পেলে যাতে তাঁর আবার বেহালা পশ্চিমে ভোটে দাঁড়াতে অসুবিধা না হয়, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন ভজা।’’
তবে এমন কিছু ওয়ার্ডও রয়েছে, যেখানে স্থানীয় কাউন্সিলরদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। ১২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি করা হয়েছে সুবীর বরাটকে, যিনি প্রাক্তন কাউন্সিলর অঞ্জন দাসের অনুগামী বলে পরিচিত। অঞ্জন ১২৯ নম্বর ওয়ার্ডের দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর ছিলেন। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী সংহিতা দাস ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং কলকাতা পুরসভার ১৪ নম্বর বোরো কমিটির চেয়ারপার্সন। তাই ওই ওয়ার্ডে ভজার বদলে অঞ্জনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে তৃণমূল। একই ভাবে ১৩০ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি করা হয়েছে কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি স্থানীয় কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি করা হয়েছে একদা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ দেবজ্যোতি গায়েনকে। তবে এখন তিনি স্থানীয় কাউন্সিলর তথা শোভন-জায়া রত্না চট্টোপাধ্যায় এবং অঞ্জন দাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন।