তৃণমূল সংসদীয় দলে ‘গৃহযুদ্ধ’ নিয়ে ময়দানে নেমে পড়ল বিজেপি। তৃণমূলের লোকসভা সাংসদদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের বিভিন্ন বক্তব্যের স্ক্রিনশট দিয়ে মঙ্গলবার সকালে তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করেছেন বিজেপি নেতা অমিত মালব্য। যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কে এই ভার্সেটাইল ইন্টারন্যাশনাল লেডি?’ প্রসঙ্গত, তৃণমূলের ওই হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে মহিলা সাংসদকে ওই বিশেষণেই ভূষিত করেছেন দলের প্রবীণ সাংসদ।
মালব্য যে স্ক্রিনশট সমাজমাধ্যমে দিয়েছেন, তাতে নাম রয়েছে তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নতুন সাংসদ কীর্তি আজাদের। রয়েছে তাঁদের মধ্যে লিখিত বাগ্যুদ্ধের ছবি। তবে ওই স্ক্রিনশটগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম। তৃণমূলের তরফেও আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। ফলে স্ক্রিনশটের কল্যাণ বা কীর্তি আদতে তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ এবং কীর্তি কিনা, তার কোনও ‘আনুষ্ঠানিক সমর্থন’ এখনও মেলেনি।
অন্য দিকে, সংশ্লিষ্ট মহিলা সাংসদ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমগ্র বিষয়টি জানিয়ে বিহিত চেয়ে যে চিঠি লিখেছেন, তা মঙ্গলবার সকালে মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে পৌঁছেছে। এখন দেখার, সমগ্র বিষয়টি কোন দিকে মোড় নেয়। তবে তৃণমূল সংসদীয় দল সূত্রের খবর, দলের অন্য কয়েক জন মহিলা সাংসদও বিষয়টি নিয়ে দলনেত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তাঁদের বক্তব্য, ওই প্রবীণ সাংসদ মাঝেমধ্যেই মহিলা সাংসদদের কাউকে কাউকে নিয়ে ‘অসম্মানজনক’ মন্তব্য করেন। নির্বাচন কমিশনের সামনে যে বিতণ্ডা হয়েছিল, তার মধ্যেও তিনি এক মহিলা সাংসদকে ‘কোটার সাংসদ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে প্রবীণ সাংসদের শিবির আবার দাবি করছে, নির্বাচন কমিশনের সামনে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার শুরুটা করেছিলেন ওই মহিলা সাংসদ, যিনি ‘মর্মাহত’ হয়ে মমতাকে চিঠি লিখেছেন।
তৃণমূলের লোকসভা এবং রাজ্যসভার সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন মমতা। লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যসভায় ডেরেক ও'ব্রায়েন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সংসদীয় দল যে মসৃণ ভাবে চলছে না, সাম্প্রতিক ঘটনা তা বলছে। তবে দলের একাধিক সাংসদের বক্তব্য, এই ঘটনাটি প্রকাশ্যে ঘটেছে বলে সকলে আলোচনা করছে। কিন্তু তার আগেও লোকসভার সংসদীয় দলের মধ্যে সংঘাত, আকচাআকচি, হুঁশিয়ারি-পাল্টা হুঁশিয়ারির ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে বাড়ছে অভিযোগ-অনুযোগের পরিসর। ইতিমধ্যেই ‘অপমানিত’ মহিলা সাংসদ লোকসভা সাংসদদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছেন। সেই সূত্রে এক নতুন সাংসদের সঙ্গে ওই প্রবীণ সাংসদের প্রকাশ্য তথা লিখিত বাগ্যুদ্ধও বেধেছে ওই গ্রুপে। তারও ‘স্ক্রিনশট’ প্রকাশ্যে এনেছএন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা অমিত।

বিজেপি নেতা অমিত মালবিয়ের সমাজমাধ্যম পোস্ট।
তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রবীণ ওই সাংসদের সঙ্গে নতুন সাংসদের সম্প্রতি একটি অবনিবনার ঘটনা ঘটেছিল। সর্বশেষ লোকসভা অধিবেশন চলাকালীন তৃণমূলের কয়েক জন সাংসদের কাছে একটি চিঠিতে সই করার কথা বলেন ওই নতুন সাংসদ। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার উদ্দেশে লেখা সেই চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের একটি পরিচিত মিষ্টির দোকানের শাখা খুলতে দেওয়া হোক নতুন সংসদ ভবনের ক্যান্টিনে। বিষয়টি জানতে পেরে সেই চিঠির লেখার উদ্যোগে বাধা দেন ওই প্রবীণ সাংসদ। বিষয়টি সরাসরি দলনেত্রী মমতাকে জানান তিনি। তার পরে হুইপ জারি করেন, কেউ যেন ওই চিঠিতে সই না করেন! ঘটনাচক্রে, দক্ষিণবঙ্গের এক মহিলা সাংসদ সম্মতিসূচক সই করে দিয়েছিলেন ওই চিঠিটিতে। পরে তিনি হুইপ মেনে সই প্রত্যাহার করে নেন। প্রবীণ সাংসদ হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে জানিয়ে দেন, বেসরকারি কোনও সংস্থার জন্য তৃণমূল কখনও উদ্যোগ নেয় না। ফলে ওই চিঠিতে সই করা যাবে না। এ-ও জানান যে, দলনেত্রীর অনুমোদন নিয়েই তিনি ওই সিদ্ধান্তের কথা সকলকে জানাচ্ছেন। নতুন সাংসদকে ফোনও করেন প্রবীণ সাংসদ। সেই ফোনের কথোপকথনও কথা কাটাকাটির পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলেই ওই বিতন্ডা সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা জানাচ্ছেন।
প্রবীণ সাংসদের আচরণে যখন মহিলা সাংসদ হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছেন, চিঠি লিখছেন মমতাকে, তখনই নতুন সাংসদের সঙ্গে লোকসভার ওই হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে তর্কাতর্কি শুরু হয় প্রবীণ সাংসদের। অনেকের মতে, যার নেপথ্যে রয়েছে মিষ্টির দোকানের শাখা খুলতে দেওয়ার বিষয়ে নতুন সাংসদের উদ্যোগী হওয়ার ঘটনাটি। প্রবীণ সাংসদের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, নতুন সাংসদ যা যা ‘কীর্তি’ করছেন, তাতে অনেকে অবাক। তাঁর লোকসভা কেন্দ্র থেকেও নানাবিধ অভিযোগ আসছে বলে দাবি সংসদীয় দলের একাংশের।
বিতর্কে জড়িয়ে-পড়া ওই প্রবীণ সাংসদ বাম জমানা থেকে তৃণমূলের হয়ে জিতছেন। দলের অন্দরে তিনি নেত্রী মমতার ‘ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন’ হিসেবেই পরিচিত। নতুন সাংসদ সরাসরি রাজনীতির লোক নন। তবে তাঁর সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞতাও খুব কম নয়। ২০২৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে প্রথম বার দাঁড়িয়ে হারিয়েছেন বিজেপির এক ওজনদার নেতাকে। ২০১৯ সালের ভোটে হেরে যাওয়া আসন গত লোকসভা নির্বাচনে পুনরুদ্ধারও করেছেন তিনি।
তবে সামগ্রিক ভাবে লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলে যে দ্বন্দ্বের আবহ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সাংসদেরা অবহিত। যদিও রাজ্যসভার পরিস্থিতি তেমন নয়। লোকসভার সংসদীয় দলের পরিস্থিতি দেখে রাজ্যসভার এক নবীন সাংসদের বক্তব্য, ‘‘লোকসভার গ্রুপে যা যা হচ্ছে বলে শুনছি, তা কলেজ ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপেও হয় না। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ধরন দেখলে বোঝা যাচ্ছে বিষয়টা বৈরিতার পর্যায়ে চলে গিয়েছে।’’
এটা প্রত্যাশিতই যে, বিজেপি তৃণমূলের অন্দরে এই ‘গৃহযুদ্ধ’ নিয়ে মাঠে নামবে। তারা নেমেওছে। এখন দেখার, দলনেত্রী মমতা বিষয়টি কী ভাবে সামলান।