বেলাগাম: পাড়ের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সে কারণেই মুখ ফেরাচ্ছে পাখিরা। ছবি: সুজিত মাহাতো
ঝাঁক বেঁধে সরোবরের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী পাখির দল। জলে আধ ডোবা হয়ে ডানা ঝাপাটাচ্ছে আরও বেশি পাখি। পুরুলিয়ার সাহেববাঁধের শীতের এই ছবি এখন স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। দূষণের জেরে পরিযায়ীরা এখন এই সরোবরের পথ ভুলেছে। যারা আসে, তারা সংখ্যায় খুবই নগন্য। সাহেববাঁধের সেই পাখিদের কোলাহল ফিরিয়ে আনতে এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে উদ্যোগী হল রাজ্য বন দফতর। সম্প্রতি নগর বিনোদন ও বনায়ন বিভাগের কর্মকর্তারা সাহেববাঁধ সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। তাঁরা এ ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনার কথা জেলা প্রশাসন ও পুরসভাকে জানাতে চলেছেন।
পুরুলিয়ার ফুসফুস বলে পরিচিত সাহেববাঁধের ৮৫ একরের জলাশয়ে ফি বছর শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি উড়ে আসত। সারাটা শীতকাল পাখির-মেলা দেখতে ভিড় জমাতেন বাসিন্দারা। দূরদূরান্ত থেকে আসতেন পক্ষিপ্রেমীরাও। কিন্তু গত কয়েক বছরে ছবিটা অনেক পাল্টে গিয়েছে। এখন মুখ ফিরিয়েছে পরিযায়ীরা। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন পরিবেশকর্মীরা। এ বার রাজ্য সরকার এগিয়ে আসায় পরিযায়ীরা ফিরবে, এই আশায় বুক বাঁধছেন তাঁরা।
নগর বিনোদন ও বনায়ন বিভাগের উপ বনপাল (দক্ষিণবঙ্গ) অঞ্জন গুহ বলেন, ‘‘এই সরোবরে পরিযায়ী পাখিদের আসা যে একেবারে কমে গিয়েছে, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। আমরা আবার অতিথি পাখিদের এই সরোবরে ফিরিয়ে আনতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা কতগুলি পরিকল্পনা নিয়েছি।’’
কী পরিকল্পনা? অঞ্জনবাবু জানাচ্ছেন, প্রথমত সাহেববাঁধের দূষণ ঠেকাতে হবে। তাঁরা ঠিক করেছেন, দূষণ ঠেকাতে গেলে বাঁধের পাড়ের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। ছাড় দেওয়া যেতে পারে, অ্যাম্বুল্যান্স ও জরুরি পরিষেবার গাড়িকে। বাঁধের পাড় থেকে একশো মিটার এলাকা ‘সাইলেন্স জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এ ছাড়া, সাহেববাঁধের পাড়ে গড়ে ওঠা গ্যারাজের বর্জ্য এবং শহরের নিকাশি নালার বর্জ্য মিশ্রিত জল যাতে কোনও ভাবেই এই সরোবরের জলে না মেশে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সাহেববাঁধকে দূষণমুক্ত করতে এই প্রস্তাবগুলি তাঁরা পুরুলিয়া পুরসভা ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠাতে চলেছেন।
১৮৩৮ সালে মানভূম জেলার সদর মানবাজার থেকে স্থানান্তরিত হয় পুরুলিয়ায়। সেই সময়ে শহরের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে জেলের কয়েদিদের দিয়ে এই বাঁধ খনন করা হয়েছিল। তারপর থেকেই গাছগাছালিতে ঘেরা নিরিবিলি এই জলাশয় কখন যেন পরিযায়ী পাখিদের প্রিয় ঠিকানা হয়ে ওঠে।
পক্ষিপ্রেমীরাও পাখি দেখতে ভিড় করতে থাকেন। ক্রমশ সাহেববাঁধের পাখিদের আনাগোনার খবর ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এই জলাশয়ে দেশ-বিদেশের কোন কোন নামের পাখিরা আসত, জলাশয় লাগোয়া জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রে তা লেখা রয়েছে।
কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এই জলাশয়ে পাখিদের আনাগোনা একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রের আধিকারিক ঋতব্রত বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা, ‘‘আমি প্রথম যখন এখানে দায়িত্ব নিয়ে আসি, তখনও অনেক প্রজাতির পাখি দেখা যেত এই জলাশয়ে। কিন্তু ইদানীং কয়েক বছর ধরে পাখি আসা একেবারেই কমে গিয়েছে।’’ শহরের নিস্তারিণী গার্লস কলেজের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, তাঁরা ২০০২ সাল থেকে জেলার বিভিন্ন জলাশয়ে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনার বিষয়ে সমীক্ষা চালান। তাঁরাও লক্ষ করেছেন, সাহেববাঁধে পাখিদের আসা অনেক কমে গিয়েছে।
পরিবেশকর্মীদের মতে, সাহেববাঁধ ঘিরে বহুতল, পাড়ে রং-বেরঙের আলো, বাঁধের চারপাশের রাস্তায় গাড়ির হর্নই পাখিদের মুখ ফেরানোর বড় কারণ। প্রায় বছর দশেক আগে শহরে গড়ে ওঠা সাহেববাঁধ বাঁচাও কমিটির মুখপাত্র প্রাক্তন আবু সুফিয়ান বলেন, ‘‘বাঁধের চারদিকের রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। তীব্র শব্দে এয়ার হর্ন বাজানো হচ্ছে। বাঁধের পাড় জুড়ে ইতিউতি গড়ে ওঠা গ্যারাজের তেলকালি ও শহরের বর্জ্য জলও মিশছে বাঁধের জলে।’’ তাঁরা বাঁধের জলের নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করিয়েছেন। রিপোর্টে দেখেছেন, জল খুবই দূষিত।
সাহেববাঁধের পাশে জেলা পরিষদ প্রেক্ষাগৃহে প্রশাসনিক বৈঠক করতে এসে বিগত পুরবোর্ডের পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী সাহেববাঁধের বিষয়ে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অঞ্জনবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রীই সাহেববাঁধের স্বাস্থ্য ফেরাতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর সাহেববাঁধ রক্ষায় গ্রিন সিটি মিশন প্রকল্পে বন দফতরকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে।
পুরপ্রধান সামিমদাদ খান বলেন, ‘‘আমরা সবরকম ভাবে ওঁদের সাহায্য করব।’’ অঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘কাজের প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই কাজের জন্য সাত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। মার্চ মাসেই কাজ শুরু করব।’’
পরিবেশ বাঁচাতে দাওয়াই
• অ্যাম্বুল্যান্স ও জরুরি পরিষেবার গাড়ি ছাড়া বাঁধের পাড় দিয়ে কোনও যানবাহন চালাতে দেওয়া যাবে না।
• বাঁধের পাড় থেকে একশো মিটার এলাকা ‘সাইলেন্স জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সেখানে কোনও হই-হট্টগোল নয়।
• পাড়ে গড়ে ওঠা গ্যারাজ এবং শহরের নিকাশি নালার বর্জ্য যাতে কোনও ভাবেই সরোবরে না মেশে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy