ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
রাত ভোর হলেই মহালয়া। শাড়ির আঁচল দিয়ে সযত্নে রেডিয়োর নব পরিষ্কার করে নন্দিনী। বিয়েতে বাবার দেওয়া উপহার। স্কুলবেলায় মহালয়ার ভোর রাতে যখন আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে, বাবা নন্দিনীকে ডাকতেন। রাঙা কাকিমা সেই কাকভোরে সবার জন্য চা বসাতেন উঠোনের পাশে মাটির উনুনে। ন’কাকু রেডিয়োটা রাখতেন বড় টেবিলের উপর। ঘি রঙের সেই রেডিয়োর সামনে দুখানা কাঠের পাল্লা ছিল। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধরতেন কলকাতা ক। গমগম করে উঠত ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির…’। এরপরেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রথম গান হত রাত্রি শেষের রাগ মালকোষে। দ্বিতীয় গানটি ভৈরব রাগে।মহালয়া ফি বছর আসে রেডিয়োর সঙ্গে তার আত্মিক যোগ নিয়ে।
বিয়েতে পাওয়া রেডিয়োটাই ছিল নন্দিনীর সবথেকে বড় উপহার। ন’কাকা, রাঙা কাকিমা, একান্নবর্তী পরিবার কিছু নেই আজ। শুধু রেডিয়োটা রয়ে গিয়েছে। মহালয়ার আগে ধুলো ঝেড়ে শোকেসের উপরে বসিয়ে নতুন ব্যাটারি কিনে তাতে ভরা হয়। নস্টালজিয়ার এইটুকু রেশ শাড়ির আঁচলে সযত্নে লালিত হয়।মহালয়ার ভোরে রেডিয়ো জানান দেয়, পুজো দোরগোড়ায়। বাঙালির কাছে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের কাউন্টডাউন শুরু হয় মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে! অন্তত এই একটা দিন বাঙালির জেগে উঠতে কোনও অ্যালার্ম লাগে না।মহালয়া পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনাকাল। পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করার দিন। শাস্ত্রমতে মহালয়ার সঙ্গে দুর্গা পুজোর তেমন কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু বাংলায় ঘরের মেয়ে উমার আগমন বার্তা শুনতে বাঙালি এত বছর ধরে মহালয়ার ভোরে রেডিয়োতেই কান পেতেছে। এই অনুষ্ঠান প্রথম যখন সম্প্রচারিত হয় সারা কলকাতা শহর নাকি শঙ্খধ্বনিতে মন্দ্রিত হয়েছিল! সেই সময় থেকে আজও জাতপাত, ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাংলা সংস্কৃতির এক আইকনিক নাম হয়ে থেকেছে! অনেকে মনে করছেন বাঙালির সেই নস্টালজিয়ায় আজকাল ভাটার টান। রেডিয়ো নামক যে যন্ত্রটির মাধ্যমে বাংলা ছাপিয়ে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই অনুষ্ঠান সেই রেডিয়োই তো বিলুপ্তির পথে! যে রূপে তাকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা তার ভোল বদলেছে আমূল। ব্রডকাস্টের চেয়ে পডকাস্টের জনপ্রিয়তা এখন উর্ধ্বমুখী।
১৯২৩ এর জুলাই মাস। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ‘বোম্বাই প্রেসিডেন্সি রেডিও ক্লাব’ এবং আরও কয়েকটি রেডিয়ো ক্লাবের সমন্বয়ে এদেশে প্রথম বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯২৫-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র পদার্থবিদ্যা বিভাগের ঘরে ট্রান্সমিটার বসিয়ে ওয়্যারলেসে গান, আবৃত্তি ইত্যাদি সম্প্রচার শুরু করেন। রেডিয়ো আবিষ্কারের জন্য জগদীশচন্দ্র বসুর নোবেল পুরস্কার না পাওয়া নিয়ে বাঙালির ক্ষোভ অপরিসীম। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর সুযোগ্য ছাত্র শিশিরকুমার মিত্র, ভারতে বেতার সম্প্রচারে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য তাঁকে বাঙালি বেমালুম ভুলে গিয়েছে!
সায়েন্স কলেজের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে’ এই গানটি দিয়ে। গেয়েছিলেন হীরেন্দ্রকুমার বসু। এরপর নানা পরীক্ষানিরীক্ষার স্তর পেরিয়ে ১৯২৭ এর ২৩ জুলাই ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’র তত্ত্বাবধানে মুম্বই বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হয়। এর এক মাসের মধ্যেই চালু হয় কলকাতা বেতার কেন্দ্র! ১, গার্স্টিন প্লেসের একটি পুরোন দোতলা বাড়িতে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর আদি কার্যালয়ও এই বাড়িতেই ছিল। এখানেই ১৯২৮ এ ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে যোগ দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠের সুবাদে বাঙালি মননে যিনি পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন!‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানটির সূচনা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। যদিও তার আগে ১৯২৭-২৮ সালে একটি ঘরোয়া আড্ডায় সেই সময়ে রেডিয়োর আধিকারিক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের আগ্রহে আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণীকুমার, রাইচাঁদ বড়াল, নিমাইচাঁদ বড়াল, প্রমুখের আলাপচারিতায় এবং পরিকল্পনায় বসন্তকালে বাসন্তীপুজোর প্রাক্কালে একটি আলেখ্য অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়। সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘বসন্তেশ্বরী’, যা বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয় একবারই।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’র মূল কারিগর ছিলেন বাণীকুমার। তাঁর দুই সহযোগী পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আজ কিংবদন্তি! সূচনাকাল থেকে কত বার যে অনুষ্ঠানটির পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অব্রাহ্মণ হওয়ায় চণ্ডীপাঠের অধিকারী নন এমন একটি বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছিল কিন্তু পরিচালক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর অন্যথা হলে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র এই ‘ক্রেজ’ তৈরি হত কিনা সন্দেহ আছে। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রচিত এমন গীতি আলেখ্য, যা ধর্ম-সম্প্রদায়ের বেড়া ভেঙে সর্বার্থেই একটি সাংস্কৃতিক ঘরানাকে উপস্থাপিত করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল!
এক সময় বেতার জগত বিশ্ব জগতকে যুক্ত করেছিল! এ যেন ছিল এক বিনিসুতোয় গাঁথা মালা! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার রূপ বদল হয়েছে। সমাজমাধ্যমের রমরমার যুগে রেডিয়ো সম্প্রচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মানুষ। দীর্ঘ তেষট্টি বছরের যাত্রা থামিয়ে বছর খানেক আগেই ভয়েস অফ আমেরিকা তার বাংলা সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে! এমন উদাহরণ খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে।
তবে রেডিয়োর রূপ বদল হলেও তার অস্তিত্ব বিলোপ হয়নি সেটাই আশার কথা।টেবিল জোড়া বাক্সের রূপ ছেড়ে ছোট হতে হতে সে এখন হাতের স্মার্টফোনে বন্দি! আর বাঙালির ‘মহালয়া’? সেও চলছে তার মতো! জামা-জুতোর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে হঠাৎ বেজে উঠছে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’ কিংবা ‘রূপং দেহী জয়ং দেহী’র কয়েক কলি!
মোবাইল স্ক্রিনে একটা টাচেই যদি যখন খুশি ‘মহালয়া’ শোনা যায় কে আর ভোর রাতের ঘুম নষ্ট করে রেডিয়ো চালাবে? অকাল বোধনেই যখন বাঙালি কার্নিভ্যালে মেতেছে ‘মহালয়া’র ‘অকাল বোধনে’ অসুবিধে কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy