ঘটনাস্থলে পড়ে রয়েছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারের ব্যাগ ও জিনিসপত্র।ছবি: শুভ্র মিত্র
চোখ বন্ধ করলেই সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটা যেন ভেসে উঠছে। শিউরে উঠে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেলছে মেয়েটি। ভুলে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই মুছতে পারছে না ওই রাতের কথা।
মেলায় কেনাকাটা করে হইচই করতে করতে ফিরছিল তারা। সেতুটা পেরিয়ে কিছুটা গেলেই গ্রাম। হঠাৎ দ্রুত বেগে পিছন থেকে গাড়ি ছুটে আসার শব্দ পেয়েই রাস্তার পাশে সরে গিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু, শেষ রক্ষা হল না। ট্রাকের চাকা পিষে দিল তার দুই ছোট্ট ভাই-বোন ও বাবাকে। মা ও দিদিও গুরুতর চোট পেয়েছে।
শনিবার রাতে বিষ্ণুপুরের রাধানগরের কাছে হরিণমুড়ি খালের সেতুর মুখে দুর্ঘটনায় এক মাত্র রক্ষা পেয়েছে মৃত কৃষ্ণপদের মেজ মেয়ে পাপিয়া। চুয়ামসিনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া পাপিয়াকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পাচ্ছিলেন না পড়শি ও আত্মীয়েরা। রবিবার তাঁদের দেখে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছিল মেয়েটি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছিল সে। কোনওরকমে সে বলে, ‘‘মেলা দেখে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। সেতুর কাছে জায়গাটা অন্ধকার। ভাই শিবমকে (১২) সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে দিদি (পূজা) হাঁটছিল। মা, বাবা ও বোন প্রিয়াঙ্কা (৭) তাদের পাশেই ছিল। আমি একটু এগিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে দ্রুত বেগে একটা গাড়ি আসার শব্দ পেয়ে সবাই রাস্তার এক পাশে সরে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ট্রাকটা দানবের মতো আমাদের পিছনেই আছড়ে পড়ল। অন্ধকারে সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।’’
ট্রাকটা সেতুর গার্ড ওয়াল ভেঙে রাস্তার পাশে ধান জমিতে নেমে গিয়েছিল। এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, তখনও রাস্তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে মেলা থেকে কেনা নতুন ভ্যানিটি ব্যাগ, চটি, জামাকাপড়ের ছেঁড়া অংশ। ভিড়ের মধ্যে থেকে গ্রামবাসী অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে রাধানগর ফাঁড়ি। কিন্তু পুলিশ আসেনি। রাতে তাঁরাই উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন। গ্রামবাসীদের দাবি, কয়েকশো মিটার দূরে রাধানগরের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাঁরাই পাঁচ জনকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। চিকিৎসক দুই নাবালককে দেখেই জানায়, ঘটনাস্থলেই ওদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, বাকিদের বিষ্ণুপুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেও অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিতে পারেনি। তাঁদের কথায়, ‘‘নামেই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। একটা মাত্র নিশ্চয়যানের অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে গর্ভবতী ও সদ্যোজাতদের জন্য। সাধারণ রোগীদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স নেই।’’ ভাড়া গাড়ি করে তাঁরা আহতদের বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক কৃষ্ণপদকে মৃত বলে জানান। লক্ষ্মী ও পূজাকে বাঁকুড়ায় স্থানান্তর করা হয়। বিষ্ণুপুর হয়ে বাঁকুড়ায় পাঠানো হয় রাধানগর গ্রন্থাগারের কাছে আগেই ট্রাকের ধাক্কায় জখম হওয়া সন্টু বাউরিকে।
গ্রামবাসী বিষ্ণুপদ ঘোষ, ঈশ্বর পান, সুকুমার পানরা বলাবলি করছিলেন, ‘‘মাস খানেক আগেই একটি সংস্থার উদ্যোগে ওই রাস্তাতেই পথ সচেতনতা চলছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছিল শিবম ও প্রিয়াঙ্কাও। তারাও ট্রাক চালকদের আস্তে গাড়ি চালাতে বলেছিল। শেষে তাদের প্রাণই কেড়ে নিল বেপরোয়া ট্রাক!’’
মাছ বিক্রেতা কৃষ্ণপদ জয়রামপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। কিন্তু, গ্রামের সবার সঙ্গেই তার মেলামেশা ছিল। পড়শিরা জানাচ্ছিলেন, সামনের অগ্রহায়ণ মাসেই তিনি বড় মেয়ে পূজার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। তার আগেই এমন দূর্ঘটনা ঘটবে কে জানত!
বাসিন্দাদের অভিযোগ, মেলায় ক’দিন ধরেই লোকজনের ভিড় হচ্ছে। কিছু দিন রাস্তায় পুলিশ ও সিভিক কর্মীরা যান নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে শনিবার দুর্ঘটনার সময়ে মেলা চত্বরের পাশের রাস্তায় পুলিশ বা সিভিক কর্মীরা কেউ ছিলেন না বলে তাঁদের অভিযোগ। বরং মেলাতেই কয়েকজন সিভিক কর্মী ছিলেন বলে তাঁদের দাবি। সেই সুযোগেই মেলার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাকটি এক সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা মারে। তারপরে আতঙ্কে ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি নিয়ে ছোটার সময় আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। পুলিশে বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুর্ঘটনার পরেও উদ্ধারে ফাঁড়ির কর্মীরা গড়িমসি করেন। সব মিলিয়ে ক্ষিপ্ত জনতা রাধানগর ফাঁড়ি রাতেই ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও হামলা চলে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের আসবাবপত্র ভাঙা। কাচের দেওয়ালেও লাঠির ঘা পড়েছিল। বিএমওএইচ হিমাদ্রিকুমার ঘটক স্বীকার করেন, ‘‘মাতৃযান ছাড়া সাধারণ রোগীদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স নেই ঠিকই। কিন্তু ৩০ শয্যার অন্তর্বিভাগ রয়েছে এখানে। হামলায় রোগীরা আতঙ্কে পড়ে যান।’’ তাঁর অভিযোগ, ভাঙা কাচে চোট পান এক মেডিক্যাল অফিসার পিন্টু মুদি। তিনি সেই অবস্থায় হামলা চালাতে আসা একটি ছেলের কাচে কেটে যাওয়া হাতের চিকিৎসাও করেন। তিনি বলেন, মহকুমাশাসকের কাছে নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানি জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে থানায় ভাঙচুরের অভিযোগ জানিয়েছি।’’ পুলিশ দাবি করেছে, ওই রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণে কেউ ছিল না, এই অভিযোগ ঠিক নয়।
হরিণমুড়ি খালের সেতু নিয়েও বাসিন্দাদের ক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের দাবি, সেতুটি জীর্ণ হয়ে গেলেও সংস্কারের বালাই নেই। শুধু মাঝে মধ্যে নীল সাদা রং করে দেওয়া হয়। রাতে সেতুতে আলো না থাকায় মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে বলে তাঁরা দাবি করে অবিলম্বে মেরামতের দাবি তুলেছেন। কিন্তু, এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের আঁচের মধ্যে একটা প্রশ্ন বারবার জয়রামপুরে পাপিয়ার পড়শিদের মুখে মুখে ঘুরছে— এই ধাক্কা কী ভাবে সামলাবে ওই মেয়েটা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy