Advertisement
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জতুগৃহের মধ্যে অসহায় দমকল

দমকলের পরিকাঠামোর হাল দেখে জেলার অনেক বাসিন্দাই অভিযোগ করে আসছিলেন, আগুন নিয়ে ছেলেখেলা করছে প্রশাসন। আশঙ্কা সত্যি করে বুধবার ভয়াবহ আগুনে ছারখার হয়ে গিয়েছে রঘুনাথপুর ১ এবং নিতুড়িয়া ব্লকের সীমানার মহারাজনগর গ্রাম। রঘুনাথপুর দমকল কেন্দ্রের ইঞ্জিনগুলিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ডিভিসির নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দু’টি ইঞ্জিন আনাতে হয়।

শুকনো পাতায় জ্বলে উঠেছে আগুন। বাঘমুণ্ডির পাখিপাহাড়ের জঙ্গলে। —ফাইল চিত্র।

শুকনো পাতায় জ্বলে উঠেছে আগুন। বাঘমুণ্ডির পাখিপাহাড়ের জঙ্গলে। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০৭
Share: Save:

দমকলের পরিকাঠামোর হাল দেখে জেলার অনেক বাসিন্দাই অভিযোগ করে আসছিলেন, আগুন নিয়ে ছেলেখেলা করছে প্রশাসন। আশঙ্কা সত্যি করে বুধবার ভয়াবহ আগুনে ছারখার হয়ে গিয়েছে রঘুনাথপুর ১ এবং নিতুড়িয়া ব্লকের সীমানার মহারাজনগর গ্রাম। রঘুনাথপুর দমকল কেন্দ্রের ইঞ্জিনগুলিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ডিভিসির নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দু’টি ইঞ্জিন আনাতে হয়। কাজ হয় না তাতেও। পুরুলিয়া থেকে আসে দমকলের আরও একটি ইঞ্জিন। সেই সময় যদি আগুন লাগত মানবাজার বা বান্দোয়ানের কোনও এলাকায়? ভেবে শিউরে উঠছেন দমকল কর্তারা। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘সে ক্ষেত্রে বসে বসে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকত না।’’ খোদ দমকল কর্তারাই জানাচ্ছেন, জেলার অবস্থা বর্তমানে জতুগৃহের থেকে ভাল কিছু নয়।

অথচ, রঘুনাথপুর মহকুমাতে দমকলের হাল জেলার অন্য মহকুমার থেকে তুলনায় ভাল। সেখানেই দমকলের মোট ৫ ইঞ্জিন ৯ ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নেভায়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় তিরিশটি বাড়ি। দমকল সূত্রের খবর, মহারাজনগর গ্রামের থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে রয়েছে একটি চেকড্যাম। সেটির থেকে জল পাওয়া গিয়েছিল বলে তাও গ্রামের কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। না হলে জেলার সর্বত্র খাল, বিল, পুকুর শুকিয়ে কাঠ। বড় জলাশয়গুলির জল তলানিতে এসে ঠেকেছে।

মহারাজনগর প্রথম নয়। দমকল সূত্রের খবর, চলতি বছরের মার্চ মাসেই জেলায় ৫৮টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি অবধি ধরলে তার সঙ্গে যোগ হবে আরও প্রায় ২০টি ঘটনা। এ দিকে টানা ৯ মাস বৃষ্টি না হওয়ায় দেখা দিয়েছে জলের হাহাকার। প্রাথমিক ভাবে যে আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন, সেই উপায় থাকছে না এলাকার বাসিন্দাদের। দমকলের জল ফুরোলেও ভরে আনার জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে হচ্ছে।

জলের সঙ্কট

জলের অভাবে কী ধরণের সমস্যায় পড়ছে দমকল? পুরুলিয়া দমকল কেন্দ্রর আধিকারিক সুদীপ চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে শোনালেন একটি ঘটনার কথা। সম্প্রতি মানবাজারের একটি গ্রামে আগুন লেগেছিল। খবর পেয়ে পুরুলিয়ার থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ উজিয়ে দমকলের ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে যায়। নিমেষেই শেয হয়ে যায় মজুত করে রাখা জল। এলাকার কোথাও জল পাওয়া যায়নি। শেষে দশ কিলোমিটার দূর থেকে ইঞ্জিনে জল ভরে আনতে হয়।

সুদীপবাবু বলেন, ‘‘একটি ইঞ্জিনে তিন হাজার লিটার জল থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ওই জলে আগুন নেভে না। ফের জল ভরতে হয়। কিন্তু দশ কিলোমিটার দূর থেকে জল ভরে আনতে আনতে যেটুকু আগুন নেভানো হয়েছিল সেটাও নতুন করে জ্বলে ওঠে।’’ দমকলের কর্মীদের কথায়,আগুন নেভানোর কাজে সময়ের দাম খুব বেশি। দশ কিলোমিটার যাওয়া, আসা এবং জল ভরার জন্য মোট যতটা সময় খরচ হয় তার প্রতি মূহুর্তে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলে।

অসহায় অপেক্ষা

বস্তুত, আগে কোথাও ছোটখাটো আগুন লাগলে স্থানীয় বাসিন্দারাই তা নিভিয়ে ফেলতে পারতেন। দমকল কর্মীরা জানান, এখন সে সমস্ত ক্ষেত্রেও ডাক পড়ছে তাঁদের। আর দমকল আসার আগে জলের অভাবে আগুন নেভানোর প্রাথমিক চেষ্টা টুকুও করতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। দমকল এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তাঁদের চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাড়ি, ঘর, ধানের গোলা।

সম্প্রতি এ রকম একটি ঘটনা ঘটে পু্ঞ্চায়। ওই এলাকার বাসিন্দা হরনাথ মুর্মুর বাড়িতে আগুন লেগেছিল। পুকুরে জল নেই। নলকূপের মুখে পাইপ লাগিয়ে হাতে পাম্প করে আগুন নেভানোর মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অচিরেই নলকূপ থেকে জল ওঠাও বন্ধ হয়ে যায়। দমকল আসার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় দু’টি বাড়ি।

অরক্ষিত এলাকা

বর্তমানে গোটা জেলায় সরকারি দমকল কেন্দ্র রয়েছে মোট তিনটি। তার মধ্যে রঘুনাথপুরের কেন্দ্রে রয়েছে ২টি ইঞ্জিন। এ ছাড়াও এই মহকুমাতে সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রঘুনাথপুরে ডিভিসির নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুরক্ষার জন্য নিজস্ব দমকল ব্যবস্থা রয়েছে।

আগুন লাগার পর রঘুনাথপুরের সরকারি দমকল কেন্দ্র এবং দু’টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইঞ্জিন দ্রুত পৌঁছতে পেরেছিল মহারাজনগর গ্রামে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সেই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে জেলার বাদবাকি বিস্তীর্ণ এলাকা।

পুরুলিয়ার দমকল কেন্দ্রে ৩টি ইঞ্জিন রয়েছে। গত জানুয়ারিতে ঝালদায় একটি দমকল কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে ২টি ইঞ্জিন। কিন্তু এই দু’টি কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে মোট ১৫টি থানা। এই পরিস্থিতিতে, জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে অগ্নি সুরক্ষা কার্যত নেই বললেই চলে।

মানবাজার, বান্দোয়ান, বোরো বা বাঘমুণ্ডির মত এলাকাগুলির কাছাকাছি কোনও দমকলকেন্দ্র নেই। বান্দোয়ানের কোনও এলাকায় আগুন লাগলে পুরুলিয়া থেকে ৮৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দমকল পৌঁছয়। সেই রাস্তা যেতে কম করে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। গত মাসে বোরো থানার জামতোড়িয়া গ্রামে হীরালাল বাস্কের বাড়িতে আগুন লাগে। পুরুলিয়াতে থেকে দমকল গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছতে দু’টি বাড়ি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়।

বৃষ্টির পথ চেয়ে

বস্তুত, এ বছর তাপমাত্রা বেশি থাকার পাশাপাশি আদ্রতাও কম। তার উপরে লু বইছে। ফলে সামান্য আগুনের ফুলকি থেকেই লঙ্কা কাণ্ড ঘটে যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন দমকল কর্তারা। এই পরিস্থিতিতে সচেতনতা গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছেন না তাঁরা। পুরুলিয়া দমকল কেন্দ্রর আধিকারিক সুদীপ চট্টোপাধ্যায় জানান, পঞ্চায়েতগুলিকে বাসিন্দাদের আগুন নিয়ে সচেতন করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।

দমকল কেন্দ্র নেই। দক্ষিণ পুরুলিয়ার বেশ কয়েকটি ব্লকের বিস্তীর্ণ ব়ৃষ্টি নামে সেই আশায় আপাতত আতঙ্কে দিন কাটছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের।

গত শনিবার বেলা আড়াইটা নাগাদ বোরো থানার দুখুরডি গ্রামে ডেকেরেটর্সের গুদামে আগুন লাগে। জোর হাওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়াতে শুরু করে। বাসিন্দারা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেন। পুরুলিয়া থেকে দমকল রওনা দেয়। কিন্তু পথে আরও এক জায়গায় আগুন নিভিয়ে যখন তারা গ্রামে এসে পৌঁছয়, ৪ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে গ্রামের পাঁচটি বাড়ি এবং দু’টি পালুই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।

একে ৮০ কিলোমিটার উজিয়ে আসা। তার উপরে, আসার পথেও অন্যত্র আগুন নেভানোর ডাক। জেলাবাসীর একাশের অভিযোগ, ‘‘দমকলের মতো জরুরি পরিষেবার গুরুত্বও প্রশাসন বুঝতে পারছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE