অশান্তির পরে নবগ্রামে চলছে পুলিশি টহল। মঙ্গলবারের নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের গাজনতলায় দুই পাড়ার মধ্যে বিবাদের ঘটনাতেও জড়িয়ে গেল রাজনীতির রং। ঘটনা ঘিরে উত্তেজনা ছড়ালো এলাকায়। হামলা হল সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্যের বাড়িতে। পাল্টা হামলার অভিযোগ তুলল তৃণমূলও। সোমবার রাতে বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি থানার নবগ্রামে হওয়া দু’দলের ওই সংঘর্ষে ঘটনায় জখম হয়েছেন গ্রামের দুই পাড়ারই জনা বারো বাসিন্দা। শেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, সম্প্রতি গাজন শুরু হয়েছে নবগ্রামে। সেই উপলক্ষে কয়েক দিন ধরেই নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে গ্রামের গাজনতলায়। সোমবার রাতেও গ্রামের গাজনতলায় একটি যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছিল। যাত্রার মাঝপথেই একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’টি পাড়ার লোকজনের মধ্যে ঝামেলা বাধে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে গ্রামের ট্রান্সফর্মারের মেন স্যুইচ নামিয়ে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ তোলে। দোষারোপ ও পাল্টা দোষারোপে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়তে থাকে। শুরু হয় হাতাহাতি। পরস্পরের উপরে লাঠি, রড নিয়ে আক্রমণ হয়। মাঝরাতে গ্রামের গাজনতলা কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়।
এরই মধ্যে এক দল গ্রামবাসী নবগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা এবং সিপিএমের স্থানীয় কাপিষ্টা লোকাল কমিটির সদস্য সমরেন্দ্র সিংহের বাড়িতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। সিপিএমের দাবি, হামলাকারীরা তৃণমূলের কর্মী। বাড়িতে তখন সপরিবার সমরেন্দ্রবাবু ও তাঁর প্রৌঢ়া মা ছিলেন। অভিযোগ, রাতে সমরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে ঢুকে হামলাকারীরা ভাঙচুর চালায়, তাঁর মোটরবাইক ও গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়। বাড়ি লক্ষ করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। তাণ্ডব দেখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে থাকেন ওই সিপিএম নেতা। সেখান থেকেই ফোন করে দলীয় কর্মীদের সব জানান। এ দিকে ঘটনার খবর পেয়েই রাতে গঙ্গাজলঘাটি থানার পুলিশ বাহিনী গ্রামে ঢুকে পরিস্থিতি সামলায়। পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে দেখেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। দুই পাড়ার ওই সংঘর্ষে আহতদের অনেককে স্থানীয় বেলিয়াতোড় ও অমরকানন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি বাঁকুড়া মেডিক্যালেও পাঠানো হয়েছে।
মঙ্গলবার সমরেন্দ্রবাবু গঙ্গাজলঘাটি থানায় এলাকার কিছু তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁর দাবি, “আমাকে খুনের উদ্দেশ্যেই তৃণমূলের লোকজন বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। ওদের হাতে লাঠি, রডের মতো অস্ত্র ছিল। কোনও রকমে লুকিয়ে বেঁচেছি।’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী বলেন, ‘‘এই নবগ্রাম এলাকায় বিধানসভা ভোটে আমরা অনেক ভোটে লিড পেয়েছি। আর সেটাই ওদের রোষের কারণ। তাই একটি গ্রাম্য বিবাদের ঘটনাকে রাজনৈতিক হামলায় পরিণত করল তৃণমূল।’’
যদিও হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে কাপিষ্টা অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি হৃদয়মাধব দুবের বক্তব্য, “কিছুদিন ধরেই গ্রামে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে নানা উস্কানিমূলক কাজ করছিল সিপিএম। সোমবার রাতের ঝামেলা তারই ফল। লাঠি, রড নিয়ে সিপিএমের লোকজনই গাজনতলায় তৃণমূল কর্মীদের উপর চড়াও হয়।’’ তাঁর আরও দাবি, সমরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে কোনও হামলাই হয়নি। পুরোটাই সাজানো নাটক! তাঁর আরও অভিযোগ, নবগ্রামের তৃণমূল কর্মী হিরালাল মণ্ডলের বাড়িতে সিপিএম কর্মীরা রাতে হামলা চালিয়ে টাকা লুঠ করেছে। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের তরফে গঙ্গাজলঘাটি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে নবগ্রামে বিশাল পুলিশ বাহিনী ও কমব্যাট ফোর্স মোতায়েন ছিল। এ দিন নতুন করে কোনও অশান্তির ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ জনা তিরিশেক গ্রামবাসীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “গ্রাম্য বিবাদ থেকেই ঝামেলা। পরে দু’টি রাজনৈতিক দলের তরফেও হামলার অভিযোগ তোলা হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’ তিনি জানান, গ্রামের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। অশান্তি এড়াতে আপাতত গ্রামে পুলিশ পিকেট থাকবে।
গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের এই এলাকাটি বড়জোড়া বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় পড়ে। এ বার ভোটে এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তীকে হারিয়েছেন সিপিএমের সুজিত চক্রবর্তী। সেই আক্রোশে ভোট ফল প্রকাশের পর থেকেই বড়জোড়া কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় বেছে বেছে তাদের নেতা-কর্মীদের উপরে শাসকদল হামলা চালাচ্ছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। সোমবার রাতে নবগ্রামের ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেই বড়জোড়ার পখন্যায় বিধায়ক সুজিতবাবুর গাড়ি আটকে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সেই সময় ওই গাড়িতে সুজিতবাবুর সঙ্গে ছিলেন সিপিএম নেতা সুজয়বাবু। তাঁরা কোনও রকমে হামলাকারীদের এড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসায় রক্ষা পান। কিছুদিন আগেও সুজিতবাবুর গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। প্রতিবাদে বাঁকুড়া-দুর্গাপুর রাজ্য সড়ক অবরোধও করে সিপিএম।
লাগাতার হামলার ঘটনা রুখতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দাবি তুলছেন বিরোধীরা। মহকুমাশাসক (বাঁকুড়া সদর) অসীমকুমার বালা বলেন, “রাজনৈতিক অশান্তি বন্ধ করতে বড়জোড়ার বিডিওকে সর্বদল বৈঠক ডাকার নির্দেশ দিয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy