Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

সকাল থেকে উদ্বিগ্ন মুখে হাসি দুপুরেই

গণনাকেন্দ্রের অদূরে ক্যাম্প অফিসে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে কর্মীরা টিফিন পেয়েছেন কি না, তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তখন থেকেই বারেবার চোখ চলে যাচ্ছিল ঘড়ির দিকে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চোয়ালটাও কঠিন। অঝোরে বৃষ্টিও শুরু হল। তার মধ্যেই কাউন্টিং এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রের ঢুকে পড়ার নির্দেশও দিলেন কিছু ক্ষণ পরে। বাইরে চেয়ারে বসে বারেবারে মুখে, মাথায় হাতও দিচ্ছিলেন।

জয়ের উচ্ছ্বাস। ভোটের ফল জানার পরে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে শিলিগুড়িতে বামফ্রন্টের মেয়র পদপ্রার্থী প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। মঙ্গলবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

জয়ের উচ্ছ্বাস। ভোটের ফল জানার পরে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে শিলিগুড়িতে বামফ্রন্টের মেয়র পদপ্রার্থী প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। মঙ্গলবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

কৌশিক চৌধুরী
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৪৯
Share: Save:

গণনাকেন্দ্রের অদূরে ক্যাম্প অফিসে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে কর্মীরা টিফিন পেয়েছেন কি না, তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তখন থেকেই বারেবার চোখ চলে যাচ্ছিল ঘড়ির দিকে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চোয়ালটাও কঠিন। অঝোরে বৃষ্টিও শুরু হল। তার মধ্যেই কাউন্টিং এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রের ঢুকে পড়ার নির্দেশও দিলেন কিছু ক্ষণ পরে। বাইরে চেয়ারে বসে বারেবারে মুখে, মাথায় হাতও দিচ্ছিলেন। গণনা শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই খবর আসে, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে অনেকটাই ‘অপ্রত্যাশিত’ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে যে ওয়ার্ডটি তৃণমূলের দখলে ছিল, তা বামেদের প্রার্থী শঙ্কর ঘোষ জিতে গিয়েছেন।

ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে বাকি ওয়ার্ডগুলির খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু ১ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ড হারতেই চাপ বাড়া শুরু হয়। দুই দশকের উপর রাজ্যের পুরমন্ত্রী বা বিধায়ক থাকলেও ৬৭ বছর বয়সে তা চোখে মুখে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বারেবারে টেলিফোনে খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। এবার যে লড়াই ‘কঠিন’ তা-ও শরীরী ভাষায় বুঝিয়ে দেন। এর মধ্যেই খবর আসে ১০ ও ২২ আরও দু’টি ওয়ার্ড জিতে গিয়েছে সিপিএম প্রার্থী কমল অগ্রবাল আর রিঙ্কি দাস।

একটু নড়েচড়ে বসেন। পকেট থেকে কাগজ কলম নিয়ে হিসাবও শুরু করেন। কিছু ক্ষণের মধ্যে মোবাইলে খবর আসে তিনি ভাল ‘মার্জিনে’ জিতে গিয়েছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে একজনের হাত ধরে বলেন, আবার খোঁজ নাও। ভিতর থেকে তো ওঁরা বাইরে আসেনি। আবার টেলিফোনে খবর আসে, ৫০০-র উপর ভোটে উনি জিতেছেন। এবার বাঁধনছাড়া শিশুর মতো। দুই হাত আকাশে তুলে ফেললেন। মুহূর্তের মধ্যে ঢপাঢপ কর্মীদের প্রণাম, হাত মেলানোর ফাঁকেই লাল আবিরে তাঁকে রাঙিয়ে দিলেন কর্মীরা। সেই সঙ্গে কাঁধে তুলে কয়েকশো কর্মী স্লোগান দেন, ‘শিলিগুড়ির নতুন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য জিন্দাবাদ’।

কিছু ক্ষণ আবেগে ভাসলেও সবাইকে সংযত করে ফের চেয়ারে বসে পড়েন। সব সময় পাশে দলের জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার। গণনার খোঁজ নিতে থাকেন। এরই মধ্যে পরপর কিছু ওয়ার্ডে তৃণমূল জিতে নেয়। ‘টক্কর’ ভালই শুরু হতে পরপর কী ওয়ার্ড রয়েছে, তা কাগজে মিলিয়ে দেখতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১০টার পর সংযোজিত এলাকায় একের পর এক ওয়ার্ডে শাসক দলের ধস নামতেই অনেকটাই যেন চিন্তামুক্ত হয়ে যান। উত্তরবঙ্গের অন্যত্র কী খবর, তা কর্মীদের থেকে জেনে নেন। নিজের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের বাকি প্রার্থীরা কত ভোট পেলেন তা-ও দেখে নেন।

জয়ের বার্তা। শিলিগুড়িতে জয়ের পরে বামফ্রন্টের মেয়র পদপ্রার্থী প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

ওয়ার্ডের কয়েকজন সিপিএম কর্মী বললেন, ‘‘অশোকদা একাই একশো। আর বাকিটা যা দরকার ছিল, তা ছয় নম্বরের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নির্দল প্রার্থী করে ফেলেছেন।’’ উল্লেখ্য, ৪৩৭৮টি ভোটের মধ্যে অশোকবাবু ১৬০৩টি, তৃণমূল প্রার্থী অরূপরতন ঘোষ ১০৩০ এবং নির্দল আলম খান ৮১৬টি ভোট পেয়েছেন।

বেলা ১২টা নাগাদ এক কর্মী এসে আবার মালা পরিয়ে দেন। এলাকার ছোট ছোট মেয়েরা এসে নতুন করে আবির মাখাতে থাকেন। তত ক্ষণে ভোটের ফল কোন দিনে যাচ্ছে, তা অনেকটাই পরিষ্কার। এর মাঝেই আবির মেখে নিজের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের কর্মীদের হাত ধরে গণনাকেন্দ্রে প্রথমবার ঢুকে জয়ীর সার্টিফিকেটও নিয়ে আসেন। তার পরে কোনও জয়ী প্রার্থী এসে প্রণাম করেছেন, কেউ হাত মিলিয়েছেন। কেউ বা আনন্দে জড়িয়ে ধরেছেন। এর ফাঁকেই বলেন, ‘‘এই জয় সব গণতন্ত্রপ্রেমী শিলিগুড়ি মানুষের জয়। দুর্নীতি, ঔদ্ধত্য, দাদাগিরি, গুন্ডামির বিরুদ্ধে জয়। আমরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলাম। আর বৃষ্টি, ভূমিকম্প উপেক্ষা করে ভোটের দিন মানুষ সেই অধিকার রক্ষা করেছেন।’’

তৃণমূলের ক্যাম্প অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন দলের কর্মী বলেই ফেলেন, ‘‘অশোক ভট্টাচার্য সেনাপতির মতো সামনে থেকে লড়াই করে বামফ্রন্টের জয় ছিনিয়ে এনেছেন। ওঁরাই একমাত্র দল, যাঁরা মেয়র হিসাবে নাম ঘোষণা করে লড়াইয়ে নেমেছিল।’’

দুপুর দেড়টা নাগাদ বামেরা ২৩ সংখ্যাটা ছুঁয়ে ফেলে। তত ক্ষণে ক্যাম্প অফিসের সামনের রাস্তা আবিরে লাল হয়ে গিয়েছে। আবার বৃষ্টি নামলেও তা উপেক্ষা করে চলতে থাকে মিছিল আর মিছিল। সংখ্যাটা ২৪ বলে কয়েকজন এসে দাবি করলেও অশোকবাবু তাঁদের কাগজ পেন খুলে দেখে তা নয় বলে দেন। কর্মীদের আশ্বস্ত করেন, জয়ী নির্দল প্রার্থী সঙ্গে থাকবেন, তাই চিন্তা নেই। শেষ কর্মীদের অনুরোধে হালকা বৃষ্টির মধ্যেই এলাকায় মিছিলের নেতৃত্বও দেন। তার পরে সোজা নিজের ওয়ার্ডে। অশোকবাবুর নেতৃত্বে হাত জোড় করে মিছিল যত এগিয়েছিল, লোক তত বেড়েছে। লাড্ডুও বিলি হয়েছে। কোনওক্রমে বার হয়ে সোজা বাড়িতে গিয়ে স্নান, খাওয়া সেরে গত কয়েকদিনের চেনা লালচে পাঞ্জাবি বদলে নেন।

এরই মধ্যে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য়ের ফোন। বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে অভিনন্দন বিনিময় করে সাংবাদিক সম্মেলন। রাতে কয়েকটি পরিচিত এলাকায় ঘুরে ঘুরে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। অশোকবাবু জানান, শরীরটা আর দিচ্ছে না। রাতে ইনসুলিনও নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘‘২৫টি আসন জিতব ভেবেছিলাম। আজ, বুধবার বিকালে বাঘাযতীন পার্ক থেকে শহরে বিজয় মিছিল করব। এখন সবাইকে শান্ত, সংযত থাকতে অনুরোধ করছি।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE