Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Narayan Debnath

Narayan Debnath: আলোর আড়ালে নারায়ণ দেবনাথ! ‘না পাওয়া’ নিয়ে আক্ষেপ করেননি কোনও দিন

ছেলেবেলায় খুব মনে হত ‘বাঁটুল’, ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘নন্টে-ফন্টে’ কমিকস-এর স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথকে কেমন দেখতে?

বাঙালির শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে হাঁদা-ভোঁদা এই দুই চরিত্র।

বাঙালির শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে হাঁদা-ভোঁদা এই দুই চরিত্র।

শান্তনু ঘোষ
শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ১৪:০৪
Share: Save:

ছেলেবেলায় খুব মনে হত ‘বাঁটুল’, ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘নন্টে-ফন্টে’ কমিকস-এর স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথকে কেমন দেখতে? যাঁর কমিকসে ‘আবার খাবো’, ‘খাই খাই রেস্তঁরা’র ছবি থেকে কেল্টুদার কেক, কাটলেট ছিনিয়ে খাওয়া কিংবা হাঁদাকে লেঙ্গি মেরে ভোঁদার চিকেন রোস্ট নিয়ে পালানোর গল্প থাকে, তিনি নিশ্চয়ই বেজায় খাদ্যরসিক!

নারায়ণী কমিকস প্যানেলে যেসব অদ্ভুত ধ্বন্যাত্মক শব্দ (যেমন ইর্‌ক!, ইয়াগ্‌হ! ওফ্স্!, অউফ্!, ইয়েও!, আউল্‌ফ্!, গুল্‌ব!, আ্যাওক! ইত্যাদি) দেখতে পাওয়া যেত সেগুলো তাঁর মাথায় আসে কোথা থেকে? আর ছন্দ মেলানো মজার সংলাপ! তারও উদাহরণ ভুরি ভুরি। কয়েকটি নমুনা— ‘মান বাঁচার বদলে এবার আমার জান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে’, ‘এই দুটোই ছিল নাটের পাণ্ডা, অবশ্য এখন এরা ঠান্ডা’, ‘আমাদের দাবী, সিন্দুকের চাবি’, ‘কি রে দাদা এযে স্রেফ কাদা’, ‘তোমার খেল খতম গুপি গুই, এবার জেলে বসে কুঁই কুঁই করো’, ‘এই আলু দিয়েই ওদের তালু ফুটো করে দেবো’, ‘এই যে পদা! নাও এই গদা! মাথা ঠান্ডা করে, লাগাও কষে জোরে’। আর তার সঙ্গে বিদঘুটে সব নাম দিতেন। যেমন– বিটকেল রাম, গুলে গুন্ডা, খুনে খ্যাদা, পাকাল পেনো, মোক্ষদা মল্লিক, বেঁটে বকেম্বর, নেংলু বাবু ইত্যাদি। সহজে অনুমেয় যে মানুষের মাথা থেকে এ সব বের হয় তিনি নিঃসন্দেহে ভীষণ রসিক মানুষ ।

স্কুলে থাকতেই দেখেছি নারায়ণ দেবনাথের চটি চটি বত্রিশ পাতার সব কমিকস বই পাওয়া যেত। সেগুলোর বাইরে তাঁর আরও অনেক কমিকস যেমন– বাহাদুর বেড়াল, গোয়েন্দা কৌশিক, পটলচাঁদ দ্যম্যাজিশিয়ান, শুটকি মুটকি— সেগুলোকে কোনও দিন বই আকারে পাইনি। কী তার কারণ জানা ছিল না। তখন ইন্টারনেটে এ সব নিয়ে কোনেও চর্চা শুরু হয়নি। যাই হোক, এ রকম অসংখ্য কৌতূহলের উত্তর খুঁজতে হাজির হয়েছিলাম নারায়ণ দেবনাথের বাড়ি। সে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। প্রথম দিনে আড্ডা হয়েছিল ঘণ্টা পাঁচেক! ছেলেবেলা থেকে জমে থাকা অসংখ্য প্রশ্ন করতে করতে কখন যে সময় কেটে গিয়েছিল জানতে পারিনি। মনে মনে যাঁকে ছেলেবেলা থেকে ‘গুরু’ বলে মেনেছি তাঁকে সামনে থেকে পেয়ে গল্প করার আশ কি সহজে মেটে!

শান্তনুকে লেখা নারায়ণ দেবনাথের চিঠির অংশ বিশেষ।

শান্তনুকে লেখা নারায়ণ দেবনাথের চিঠির অংশ বিশেষ। —নিজস্ব চিত্র।

পরে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে কখন যে তাঁর পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি। কাছ থেকে দেখার সুবাদে বুঝেছি তিনি সত্যিই একজন রসিক, বিনয়ী, নম্র স্বভাবের প্রচারবিমুখ মানুষ। সারাক্ষণ তিনি তাঁর কাজের টেবিলে ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। প্রায় ৯২ বছর পর্যন্ত নিয়মিত কমিকস তৈরি করে গিয়েছেন ‘শুকতারা’র জন্য। দীর্ঘ প্রায় ৬৫ বছর ধরে করেছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাতার বেশি কমিকস! বিশ্ব কমিকসের নিরিখে একক হাতে গল্প লিখে, চিত্রনাট্য সাজিয়ে ছবি দিয়ে এই সুবিশাল কমিকস সাম্রাজ্য সৃষ্টি এক কথায় বিরল।

মানুষটাও ছিলেন এক বিরল প্রতিভার। ছবি আঁকা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জানেন একই শিল্পীর হাতে সিরিয়াস/রিয়েলিস্টিক ছবি ও কমিক্যাল/ফানিস ছবি বের হওয়া সহজ নয়। শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ অনায়াসে রিয়েলিস্টিক ‘গোয়েন্দা কৌশিক রায়’ বা ’গোয়েন্দা ইন্দ্রজিৎ রায়’-এর পাশাপাশি ফানিস বাঁটুল-হাঁদাভোঁদা-নন্টেফন্টে বা বাহাদুর বেড়াল এঁকেছেন! ছবি আঁকার পাশাপাশি মুক্তোর মতো গোটা গোটা অক্ষরে সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর কমিকসের প্যানেল বা হরেক বইয়ের প্রচ্ছদের নামলিপি! আমরা জানি বাঁটুল-হাদাভোঁদা-নন্টেফন্টে প্রতিটাই অতিক্রম করেছে ৫০ বছরের ল্যান্ডমার্ক। আনন্দের কথা তিনি জীবদ্দশায় সেই সুবর্ণজয়ন্তী দেখে গিয়েছেন। আর আফসোসের কথা বিদেশে যে ভাবে টিনটিন বা অ্যাসটেরিক্সের সুবর্ণজয়ন্তী সেলিব্রেশন হয় রোড শো, প্রদর্শনী, সেমিনারের মাধ্যমে, আমাদের এই পোড়া দেশে নারায়ণী কমিকস নিয়ে তা এখনও হয়নি। একান্ত আলাপচরিতায় কখনও কখনও নারায়ণবাবুর কাছে এই নিয়ে জানতে চেয়েছি যে তাঁর কোনও আক্ষেপ আছে কি না। উত্তরে মিষ্টি হেসে তিনি জানিয়েছিলেন, কোনও কিছু না পাওয়া নিয়েই তাঁর আক্ষেপ নেই। বরং বলতেন, তিনি সকলের কাছে যে ভালবাসা পেয়েছেন সেটাই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

একসময় অফিস ফেরত সময় পেলে যেতাম নারায়ণবাবুর বাড়িতে। উনি ওঁর পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া পত্রপত্রিকা বা বইয়ের অলংকরণ দেখতে খুব ভালবাসতেন। আমি কলেজ স্ট্রিট ও গোলপার্কের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করা বই, পত্রিকা নিয়ে হাজির হতাম ওঁর কাছে। খাদ্যরসিক এই মানুষটি ভালবাসতেন ফিসফ্রাই, কাটলেট খেতে। সেই সব তেলেভাজা খেতে খেতে আড্ডায় যখন পুরনো শুকতারার পাতায় ওঁর বিভিন্ন অলংকরণ দেখতেন তখন বলে উঠতেন— ‘এ সব কাজ আমি করেছি! এতো ভুলেই গেছিলাম!’ সেই সময় আমার খুব আনন্দ হত। এ সব পাগলামোর জন্য উনি আমায় ভালবেসে ‘আমার একমাত্র চ্যালা’ বলে ডাকতেন।

নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে শান্তনু।

নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে শান্তনু। —নিজস্ব চিত্র।

ওঁর কাছে প্রথম যখন জানতে চেয়েছিলাম যে বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা কবে থেকে শুরু হয়েছিল? উনি নির্বিকার ভাবে উত্তর দিতেন ‘সে কবেকার কথা, সে কি আর মনে আছে? ’জবাব না পেয়ে ছুটেছিলাম পত্রিকার দফতরে। সেখানেও সেই একই জবাব! অগত্যা উপায় না দেখে বিভিন্ন পুরনো লাইব্রেরি যেমন— হীরণ লাইব্রেরি, বাগবাজার লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি, রামমোহন লাইব্রেরি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি-সহ পুরনো বইয়ের দোকান খুঁজে খুঁজে ওঁর সৃষ্ট সবকটি কমিকস চরিত্রের প্রথম প্রকাশকাল বের করতে পেরেছিলাম। সেই কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম ওঁর অসংখ্য কমিকস পত্রিকার পাতা থেকে বই হওয়ার সময় বাদ পড়ে গিয়েছিল। সেইসব দুষ্প্রাপ্য ‘অগ্রন্থিত’ কমিকস ও অলংকরণ নিয়ে আমার সম্পাদনায় ২০১১-তে প্রায় ৫০০ পাতার সুবিশাল ‘নারায়ণ দেবনাথ কমিক্‌স সমগ্র ১’ প্রকাশিত হয়। এর পরের কয়েক বছরে প্রকাশিত হয় আরও চারটি খণ্ড। অবশেষে ২০১৩-তে এই ‘নারায়ণ দেবনাথ কমিক্‌স সমগ্র’র জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নারায়ণ দেবনাথকে ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার দেওয়া হয়। একজন সামান্য ভক্ত হিসেবে এ আমার পরম পাওয়া। ইতিমধ্যে একে একে প্রকাশিত হয়েছে বাহাদুর বেড়াল, গোয়েন্দা কৌশিক, ডানপিটে খাঁদুর একক কমিকস সংকলন। এই রকম প্রায় ১৫টি বইয়ের সংকলন ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।

আমরা সবাই নারায়ণ দেবনাথ বলতেই বুঝি তিনি একজন কমিকস শিল্পী। কিন্তু নারায়ণবাবু তার কেরিয়ার শুরু করেছিলেন একজন গ্রন্থ-অলংকরণ শিল্পী হিসেবে এবং নিজেকে বলতেন ‘আমি প্রথমে অলংকরণ শিল্পী তারপর শিশু সাহিত্যিক।’ যেহেতু প্রতিটা কমিকসের মধ্যে একটা গল্প থাকে, তাই তাকে ‘সাহিত্য’ বলতে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৫০ সাল থেকে শুকতারার পাতায় অলংকরণশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন এবং ১৯৬১-৬২ সাল নাগাদ পুরোপুরি কমিকস তৈরি করা শুরু করেন। আজ ভাবতে ভাল লাগছে, একদা যাঁরা কমিকসকে সাহিত্যের মর্যাদা দিতে দ্বিধা করতেন, তাঁরাও আজ নারায়ণ দেবনাথ চর্চায় সমান ভাবে এগিয়ে এসেছেন। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন পদ্মশ্রী, বঙ্গবিভূষণ, সম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি (রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে), বিদ্যাসাগর পুরস্কার। এ কেবল নারায়ণ দেবনাথের নয়, সমগ্র বাঙালি শিল্পী ও ছবিপ্রেমী পাঠকের স্বীকৃতি।

(নারায়ণ দেবনাথের কাজ নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণারত)

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Debnath Bengali Cartoonist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy