Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Narayan Debnath

Narayan Debnath: সাদাসিধে মানুষ, এঁকে যেতেন, কখনও বিষণ্ণ হতে দেখিনি, আমার দেখা নারায়ণ দেবনাথ

এক জন ইলাস্ট্রেটর হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। তিনি ছিলেন বহুমুখী। সিরিয়াস গল্প এবং মজার ছবি, দুইই আঁকতেন খুব ভাল।

প্রথমে বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন আঁকায় ঝোঁক থাকলেও পরে কমিক্‌স আঁকা শুরু করেন  নারায়ণ দেবনাথ।

প্রথমে বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন আঁকায় ঝোঁক থাকলেও পরে কমিক্‌স আঁকা শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

দেবাশীষ দেব
দেবাশীষ দেব
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২২ ১১:২৪
Share: Save:

যে কোনও শিল্পীকে জানতে গেলে তিনি যে সময়ের ভিতর দিয়ে গিয়েছেন তা জানতে হয়। নারায়ণ দেবনাথের ক্ষেত্রেও সেই প্রেক্ষাপটটি জানা প্রয়োজন।
নারায়ণ দেবনাথের পরিবার চলে আসে এ পার বাংলায়। শিবপুরে ওঁর বাবা, জ্যাঠারা বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই ওঁর জন্ম। ওঁদের গয়নার ব্যবসা ছিল। ওঁর বাবা-কাকারা গয়নার ডিজাইন করতেন। সেগুলো দেখতে দেখতেই ওঁর বেড়ে ওঠা এবং তৈরি হয় আঁকার প্রতি উৎসাহ । পরবর্তীকালে উনি আর্ট কলেজেও ভর্তি হন। পরে যার নাম হয়েছিল ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ । এ সব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘটনা।

তিরিশ-চল্লিশের দশকে আঁকার খুব বেশি বইপত্র ছিল না। ইলাস্ট্রেশনের কাজও অত হত না। নারায়ণ দেবনাথ পড়াশোনা করেছিলেন পেন্টিং নিয়ে। কিন্তু সেই সময় পেন্টিংয়ে স্থায়ী রোজগার বলতে তেমন কিছু ছিল না। ফলে কমার্শিয়াল আর্টের দিকে যাওয়া স্থির করেন উনি। বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন আঁকার দিকে ওঁর ঝোঁক ছিল। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার জন্য দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে সেই সময় ওঁর যোগাযোগ হয়। ওখানকার সম্পাদক যাঁরা ছিলেন তাঁরা খুশি হয়ে ওঁকে ওই কাজে ডেকে নেন। পঞ্চাশের দশক থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে ছোটদের যে বইগুলি বেরোত তাতে উনি প্রচুর ইলাস্ট্রেশন করতেন। শুকতারা তখন প্রকাশিত হচ্ছে। ওখানেও উনি নিয়মিত কাজ করতে শুরু করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তখন সমাজজীবনের মোড় একটু একটু করে অন্য দিকে ঘুরছে। ওঁর সমসাময়িক অনেক শিল্পী, ইলাস্ট্রেটররা তত দিনে এসে গিয়েছেন। ওঁর সিনিয়রদের মধ্যে প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইবন্ধু রায়, শৈল চক্রবর্তী, সমর দে, রেবতীভূষণ ঘোষ এঁরা সবাই ছিলেন। তবে নারায়ণ দেবনাথ নিজে একটা পৃথক ধারা তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রতুলবাবু নিজে ওঁকে নানা ভাবে গাইড করতেন। দেশি-বিদেশি ছবি, ইলাস্ট্রেশন দেখাতেন। শুকতারার সম্পাদকমন্ডলীর ক্ষিতীশ মজুমদারও ওঁকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন।

এক জন ইলাস্ট্রেটর হিসাবে নারায়ণ দেবনাথ ছিলেন বহুমুখী। সিরিয়াস গল্প এবং মজার ছবি, দুইয়ের সঙ্গেই আঁকতেন খুব ভাল। আমি তো ছোট থেকেই ওঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি দেখতাম উনি বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকতে পারেন। কখনও হাসি, কখনও গুরুগম্ভীর। সেটা ওঁর সময়ে আর কেউ পারতেন না। ১৯৬০ এর দশকে ‘বনে-জঙ্গলে’ বলে যে বইটি বেরিয়েছিল তার ইলাস্ট্রেশন অসম্ভব খুঁটিয়ে এঁকেছিলেন উনি। খুঁটিয়ে আঁকার দিকে উনি প্রথম থেকেই দারুণ জোর দিতেন। একটি ছবিকে ভীষণ আকর্ষণীয় আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে ওঁর নজর থাকত সারা ক্ষণ। সে জন্য উনি খুব খাটতেন। ওঁর আঁকাও খুব শক্তিশালী ছিল।সবই উনি ধীরে ধীরে রপ্ত করেছিলেন।

সৃষ্টিতে ব্যস্ত শিল্পী।

সৃষ্টিতে ব্যস্ত শিল্পী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

আঁকার ক্ষেত্রে স্থান, কাল, পাত্র, চরিত্র, তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি নির্ভুল ভাবে দেখানোর ক্ষেত্রে উনি বরাবর খুব জোর দিতেন। নিজেই বলেছেন, ‘আমি চেষ্টা করতাম সঠিক রেফারেন্স খুঁজে বের করতে।’ প্রয়োজনে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথের দোকান থেকে শুরু করে জাতীয় গ্রন্থাগার পর্যন্ত দৌড়তেন। এখনকার মতো তখন তো গুগল সার্চ ইঞ্জিন ছিল না। তাই আঁকাটাকে বাস্তব করে তোলার জন্য যথেষ্ট খাটতে হত। ষাটের দশকের গোড়ায় ইলাস্ট্রেশনের পাশাপাশি শুকতারা পত্রিকার সম্পাদক ওঁকে বললেন কমিকস শুরু করতে। সেই কথা মতো, ১৯৬২ সালে হাঁদা আর ভোঁদা এই দুটি চরিত্র নিয়ে ‘শুকতারা’তে কমিকস শুরু করেন উনি। এ বিষয়ে ওঁর কোনও প্রস্তুতি ছিল না। মজার ব্যাপার, এক টারজান বাদে দেশ-বিদেশের কমিকসও যে উনি খুব একটা দেখতেন এমন নয়। তাও কমিকসের কাজ শুরু করে এই ক্ষেত্রটিকে উনি খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ব করে নিলেন। শিবপুরে একটু ঘিঞ্জি এলাকায় ওঁর বাড়ি। চারপাশে দোকানপাট লোকজন। উনি খুব ছোটবেলা থেকেই বসে বসে দেখতেন, সেই সব চরিত্রদের নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ ঠাট্টা তামাশা করতে। এ সব থেকেই হাঁদা-ভোঁদার গল্পের প্লট পেতে লাগলেন উনি। লোকে হাঁদা-ভোঁদা চরিত্র দু’টিকে ভালোবেসে ফেলল। এর পর ১৯৬৫ সাল নাগাদ উনি বাঁটুল দি গ্রেট চরিত্রটি নিয়ে আরও একটি কমিকস শুরু করেন। ব্যায়ামবীর মার্কা বাঁটুলের কীর্তিকলাপও পাঠকদের মধ্যে দারুণ ভাবে সাড়া ফেলে দিল এবং শেষপর্যন্ত উনি পুরোপুরি কমিকসের দিকেই চলে গেলেন। ‘কিশোর ভারতী’ও তাদের জন্য ওঁর কাছে কমিকস চাইল। তখন উনি অনেকটা হাঁদা-ভোঁদার আদলে নন্টে-ফন্টে তৈরি করলেন। তবে গল্পগুলি একটু আলাদা। পরের দিকে ‘বাহাদুর বেড়াল ‘ডানপিটে খাঁদু ও তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘গোয়েন্দা কৌশিক’-এর মতো নানা রকমের কমিকস করেছেন। একটা সময় প্রায় ছয়-সাতটি কমিকস করে গিয়েছেন একসঙ্গে। ফলে বাধ্য হয়ে একসময় ইলাস্ট্রেশন করা ছেড়ে দিতে হল। শেষের দিকে ওঁর ‘টারজান’, ‘অমর বীর কথা’ এই সব সিরিজগুলিতে অসাধারণ সব ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন। আমাদের স্মৃতিতে এখনও এই সব কাজ উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বাঙালির শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে হাঁদা-ভোঁদা এই দুই চরিত্র।

বাঙালির শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে হাঁদা-ভোঁদা এই দুই চরিত্র। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

প্রায় ৫০ বছর ধরে উনি টানা কমিকস করেছেন। যাকে প্রায় বিশ্বরেকর্ড বলা যায়। আর কোনও দেশের কোনও চিত্রশিল্পী বোধ হয় এমন ভাবে কাজ করেননি। উনি মানুষ হিসাবে অত্যন্ত সাধাসিধে এবং সহজ সরল ছিলেন। কোনও রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। দেব সাহিত্য কুটিরে চিরকাল ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজ করেছেন। স্থায়ী চাকরি করেননি। এর ফলে একটা সময় এসেছিল যখন আর্থিক ভাবে কিছুটা অসুবিধায় পড়লেন। নব্বইয়ের দশকে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর থেকে ওখানে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন, কিন্তু উনি রাজি হলেন না। এখন অবশ্য অনেকেই বলেন, ওটা ঐতিহাসিক ভুল হয়েছিল। যদিও এটা উনি গায়ে মাখেননি। দুর্ভাগ্যের কথা, ওঁর মতো মানুষের যোগ্য স্বীকৃতি, সম্মান ইত্যাদি পেতে অনেক দেরি হয়েছিল।

আমি ওঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করি প্রায় ২০০০ সাল থেকে। তবে সম্মান প্রাপ্তি নিয়ে ওঁর মনে বিরাট একটা ক্ষোভ কখনই দেখিনি। উনি খুব আত্মতৃপ্ত মানুষ ছিলেন। নিজের মনে এঁকে যেতেন। যত দিন সুস্থ ছিলেন এঁকেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা-ও এক সময় বন্ধ করে দিলেন। নতুন করে আর বাঁটুল বা হাঁদা-ভোঁদা দেখতে পেলাম না।

শেষ বয়েসে এসে উনি লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ওঁর অর্তমানে বাঁটুল বা হাঁদা-ভোঁদা অন্য কোনও শিল্পী যেন না আঁকেন। বিদেশে এটা খুব হয়। প্রতিষ্ঠিত একটি কার্টুন চরিত্রকে অনেকে আঁকেন। আবার টিনটিনের স্রষ্টা বলে গিয়েছিলেন যে তাঁর পরে আর কেউ যেন ওই চরিত্র না আঁকেন। নারায়ণ দেবনাথের অবর্তমানে বাঁটুল বা হাঁদা-ভোঁদা অন্য কোনও শিল্পী আঁকবেন না। এটা স্থির হয়ে গিয়েছে। উনি বাঁটুলকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন তা বাঙালির কাছে আইকনের মতো। নন্টে-ফন্টের মতো চরিত্রগুলোও আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সেটাই ওঁর কৃতিত্ব। দীর্ঘ দিন ধরে উনি এই চরিত্রগুলিকে নিয়ে গল্প বলে গিয়েছেন। পুজো সংখ্যাগুলিতেও অনেক কমিক্‌স স্ট্রিপ আঁকতেন। এ সবই বিরাট সাফল্য বলে আমার মনে হয়। তাঁর অবর্তমানে আমরা সেগুলি নিয়েই থাকব। নিঃসন্দেহে সেগুলিই আমাদের চিরকাল আনন্দ দিয়ে যাবে।

(লেখক চিত্রশিল্পী)

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Debnath cartoonist Bengali Cartoonist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy