Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

খুদেদের ভাত-ঘুম কাটাতে গল্পের আসর স্কুলে স্কুলে

সোনার হাঁস পাড়া ডিমটা কাটতেই...। —বাক্যটা শেষ হয়নি, তার আগেই খলখলিয়ে হেসে উঠল গোটা ক্লাস। নিজের ভুল বুঝতে পেরে লম্বা জিভ কাটে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি। সলজ্জ চোখটা ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় গোটা ক্লাসঘরটা।

চলছে গল্প বলার ক্লাস। — নিজস্ব চিত্র।

চলছে গল্প বলার ক্লাস। — নিজস্ব চিত্র।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:১০
Share: Save:

সোনার হাঁস পাড়া ডিমটা কাটতেই...।

—বাক্যটা শেষ হয়নি, তার আগেই খলখলিয়ে হেসে উঠল গোটা ক্লাস। নিজের ভুল বুঝতে পেরে লম্বা জিভ কাটে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি। সলজ্জ চোখটা ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় গোটা ক্লাসঘরটা। তার পর ফের বলতে থাকে— “চাষি সোনার ডিম পড়া হাঁসটা কাটতেই...।”

তাতেও হাসির রোল ওঠে গোটা ক্লাসে। এ বার ধমক দিলেন শিক্ষিকা। কিন্তু কচিকাচাকে চুপ করানো গেল না। গল্পের ওই ভুলটুকুতেই যেন চনমনিয়ে উঠেছে গোটা ক্লাস। বোঝা যায়, ‘ওষুধ’-এ কাজ দিয়েছে।

ওষুধই বটে। সম্প্রতি স্কুলগুলোকে এ দাওয়াই প্রেসক্রাইব করেছে নদিয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। তারা এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিয়েছে, প্রতি দিন মিড ডে মিল খাওয়ার পরে ১৫ মিনিট কোনও প্রথাগত শিক্ষা নয়। গল্প, ছবি আঁকা, খবর পাঠ বা ইংরাজি-বাংলাতে নাম, ঠিকানা লেখা অভ্যাস করাতে হবে। আয়োজন করতে হবে কুইজ, নাটক, ব্রতচারির।

কেন এমন নির্দেশিকা?

শিক্ষা সংসদের দাবি, দুপুরে পেট ভরে মিড ডে মিলের গরম ভাত খাওয়ার পরে ছাত্রছাত্রীদের শরীরে আলস্য আসে। ফলে খাওয়ার পরে ক্লাসে আর তাদের সে ভাবে মন বসতে চায় না। তাই গতানুগতিক পড়াশুনোর বাইরে ওই সময়টা তাদের এমন কিছু কাছে ব্যস্ত রাখা দরকার, যাতে আলস্য চলে যায়। আর তারই দাওয়াই হিসাবে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে দাবি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি রমাপ্রসাদ রায়। তিনি বলেন, “আসলে ভাত-ঘুম বলে একটা কথা আছে না। সেটা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে দেখা যায়। সেটা কাটানোর জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।” তিনি বলেন, “আমরা চাইছি তাদের মনের উপরে কোনও রকম চাপ না দিয়ে একটু অন্য রকম ভাবে পঠনপাঠনে উৎসাহিত করতে। তাই তো গল্প বলা, ব্রতচারির পাশাপাশি নানা রকম খেলাধুলোর উপকরণ কিনে দেওয়া হচ্ছে।”

প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের এই উদ্যোগ যে কাজে এসেছে তা জানাচ্ছেন, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। নাকাশিপাড়ার ধর্মদা বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রীবাস দাস বলেন, “আমরা তো রীতিমতো রুটিন করে নিয়েছি। দুপুরে ভাত খেলে আমাদেরই তো ঘুম পায়। আর ওরা তো বাচ্চা। এই ১৫ মিনিট আমরা ওদের একটু অন্য রকম পরিবেশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। যাতে পড়াশুনোর পরিবেশটাও থাকল, আবার ওদের ভাত-ঘুমটাও কেটে যায়।”

তবে সব কিছুর মধ্যে কুইজেই উৎসাহ দেখাচ্ছে পড়ুয়ারা। অন্তত এমনটাই মনে করছেন শিক্ষকরা। আর সেটা জেলা সদর হোক বা প্রত্যন্ত গ্রাম। কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের প্রধানশিক্ষক রঞ্জন সাহা যেমন বললেন, “মিড ডে মিল খাওয়ার পরে পড়াশুনোয় মন বসানো পড়ুয়াদের পক্ষে সত্যিই কঠিন। এখন কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না। ওরা বেশ চনমনেই থাকছে। আর তার প্রভাব পড়ছে পঠনপাঠনেও। তবে কুইজেই ওদের আগ্রহ বেশি।
কারণ তাতে যে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে।”

এ সবের পাশাপাশি স্কুলে পড়ুয়াদের সক্রিয় ও চনমনে রাখতে আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা সংসদ। যেমন, জেলার স্কুলগুলোর মধ্যে থেকে এমন দু’শোটি স্কুলকে বেছে নেওয়া হয়েছে যাদের বড় খেলার মাঠ আছে। সেই সব স্কুলের জন্য ফুটবল, ড্রাম, লাফ দড়ি ও ফ্লাইং ডিস্ক দেওয়া হচ্ছে।

তবে বিষযটা যে খুব সহজে হচ্ছে, তা নয়। শিক্ষকদের দাবি, স্কুলে কেন পড়াশুনোর বাইরে গল্পবলা অন্য ধরনের ক্লাস হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন কিছু অভিভাবক। তাঁদের কথায়, এতে নাকি পঠনপাঠনের সময় কমে যাচ্ছে।

তা হলে? রমাপ্রসাদবাবু বলেন, “সকলকেই বুঝতে হবে পড়ুয়াদের সার্বিক বিকাশের জন্যই আমাদের এত ভাবনাচিন্তা। শুধু শিক্ষকরা উদ্যোগী হলেই হবে না, সচেতন ভাবে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদেরও।”

অন্য বিষয়গুলি:

Storytelling Classes Storytelling Primary Schools
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE