এত দিন গুঞ্জনটা চলছিলই তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে। রবিবার সন্ধ্যায় লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হতেই শুরু হয়ে গেল জোর চর্চা— নদিয়ার দু’টি কেন্দ্রে দলের প্রার্থী কে হচ্ছেন।
জেলা তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত দলের সর্বোচ্চ স্তরে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু জল্পনা থামাবে কে? নিচুতলার কর্মীরা, যাঁরা ইতিমধ্যে দেওয়াল দখল করতে নেমে পড়েছেন, তাঁরা জানতে চান আগামী ২৯ এপ্রিল কারা জোড়াফুল চিহ্ন নিয়ে লড়তে নামছেন।
গত বার জোড়া-তাপস নিয়ে নেমেছিল তৃণমূল। নানা কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত তাপস পালের কৃষ্ণনগরে টিকিট পাওয়ার যে সম্ভাবনা নেই, তা প্রায় স্পষ্ট। রানাঘাট কেন্দ্রে আবার বিদায়ী সাংসদ তাপস মণ্ডলের ফের প্রার্থী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কেননা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক তৃণমূল নেতাই বলছেন, অন্য রকমের কোনও প্রয়োজন না থাকলে ‘উইনিং ক্যান্ডিডেট’ পাল্টানো দস্তুর নয়। ফলে জেলা থেকে তাপসের নামই প্রস্তাব হিসেবে রাজ্যে পাঠানো হতে পারে। তাপস নিজে যা-ই চান, মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তাঁর কথায়, “এই নিয়ে কথা বলার এক্তিয়ারই আমার নেই।’’
কিন্তু কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের কী হবে? তার কোনও স্পষ্ট উত্তর রাত পর্যন্ত না মিললেও একটা ব্যাপার পরিষ্কার। তা হল, তাপস পাল নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার পরে জেলা নেতারা প্রায় কেউই চাইছেন না, বাইরে থেকে তারকা প্রার্থী এনে দাঁড় করানো হোক। বরং জেলায় কাজ করা কোনও নেতা দাঁড়ালেই বেশি লাভ হবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে যে দু’টি নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, তার একটি হাতের তালুর মতো জেলার সংগঠন চেনা শঙ্কর সিংহ। বর্ষীয়ান এই নেতার উপরে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বড় অংশের ভরসা আছে। দ্বিতীয় নামটি তুলনায় অনেক তরুণ মহুয়া মৈত্রের। মহুয়া যদিও নদিয়ার বাসিন্দা নন, কিন্তু করিমপুরের বিধায়ক হওয়ার সুবাদে পাঁচ বছরেরও বেশি ধরে তিনি জেলায় পড়ে রয়েছেন।
সম্প্রতি জেলাসফরে এসে কর্মীদের নিয়ে বৈঠকে মহুয়া এবং কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীম সাহাকে এই কেন্দ্রের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই থেকে তাঁরা দু’জন গোটা কৃষ্ণনগর লোকসভা এলাকা চষছেন। তা থেকেই অনেকে মনে করছেন, তাঁকে প্রার্থী করা হতে পারে। কংগ্রেসে থাকাকালীন দীর্ঘ দিন দিল্লীর রাজনীতিতে অভ্যস্ত, ফুরফুরে ইংরেজি বলা বলিয়ে-কইয়ে মহুয়াকে প্রান্তিক এলাকা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নেত্রী উৎসাহী হতে পারেন বলে তাঁদের ধারণা। মহুয়া নিজে অবশ্য বলছেন, “আমি এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। নেত্রী আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি মন দিয়ে করার চেষ্টা করছি।”
‘ঠোঁটকাটা’ মহুয়া নন, জেলার নেতাদের একটা অংশ অবশ্য রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক শঙ্কর সিংহের দিকেই ঝুঁকে রয়েছেন। তাঁদের মতে, বিজেপির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে এমন এক জন নেতাকে সামনে রাখা প্রয়োজন যাঁর সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সেই দিক দিয়ে মহুয়ার তুলনায় শঙ্কর শুধু যোগ্যতর নন, জেলায় সবচেয়ে উপযুক্ত। এক জেলা নেতার দাবি, “এক মাত্র শঙ্করদারই প্রতিটি বুথে নিজের লোক আছে। গোটা জেলাটা তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন।”
শঙ্কর নিজে অবশ্য প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। জেলা নেতাদের একাংশের দাবি, এই প্রস্তাব শুনেই তিনি পত্রপাঠ না করে দিয়েছেন। শঙ্কর-ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, তিনি নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, রানাঘাট কেন্দ্রের অবস্থা সুবিধার নয়। সেই কারণে তিনি ওই কেন্দ্রেই বেশি সময় দিতে চান। কৃষ্ণনগরে দাঁড়ালে সেটা তিনি করতে পারবেন না। শঙ্কর অবশ্য এ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করতে রাজি নন। নিয়মনাফিক তিনি শুধু বলেন, ‘‘দলের সর্বোচ্চ নেত্রীই এক মাত্র মন্তব্য করতে পারেন। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই শেষ কথা।”
আলোচনায় রয়েছে শান্তিপুরের এক নেতার কথাও। দলের একটি সূত্রের দাবি, সম্প্রতি তিনি কলকাতায় গিয়ে এক রাজ্য নেতার সঙ্গে দেখাও করেছেন। তবে তিনি নিজে তা স্বীকার করতে রাজি নন। তাঁর দাবি, নিজের বৃত্তেই তিনি বেশি সচ্ছন্দ।
এই দু’জনের বাইরে একটি তৃতীয় সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে দলের অন্দরে কান পাতলে। জেলা নেতাদের একটি অংশ চাইছেন, বিজেপিকে রুখতে কৃষ্ণনগরে মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করানো হোক। এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩৬ শতাংশ। বিজেপি যে ভাবে হিন্দুত্বের তাস খেলছে তাতে মতুয়া-সহ হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের একটা অংশে ফাটল ধরার সমূহ সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত করতে পারলে জেতার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে তৃণমূলের। কিন্তু এখনও গ্রহণযোগ্য কোনও প্রার্থীর নাম সে ভাবে উঠে আসেনি।
বাকি নেতাদের মতো জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তও আপাতত জল্পনার চোরাবালিতে পা দিতে রাজি নন। বরং স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে তিনি দাবি করেন, “নেত্রী যাঁকে প্রার্থী করবেন, তাঁকেই আমরা বিপুল ভোটে জিতিয়ে আনব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy