Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

জমি জটের ফাঁদে বহরমপুর বাইপাস

যানজট থেকে বহরমপুরকে বাঁচাতে বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা করেছিল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। কোন দিক দিয়ে সেই বাইপাস হবে তার নকশাও তৈরি হয়েছিল। অধিগ্রহণ করা হয়েছিল প্রয়োজনীয় জমিও।

বন্ধ রয়েছে কাজ। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বন্ধ রয়েছে কাজ। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১২
Share: Save:

যানজট থেকে বহরমপুরকে বাঁচাতে বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা করেছিল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। কোন দিক দিয়ে সেই বাইপাস হবে তার নকশাও তৈরি হয়েছিল। অধিগ্রহণ করা হয়েছিল প্রয়োজনীয় জমিও। কিন্তু নকশা তৈরির প্রায় সাড়ে চার বছর পরেও কাজই শুরু করতে পারল না নির্মাণকারী সংস্থা, হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকসন কোম্পানি। তাদের দাবি, জমি জটের কারণেই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। গত ১৯ অগস্ট সমস্যার সমাধান করতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চেয়ে গোটা বিষয়টি লিখিত ভাবে তারা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। জমি নিয়ে সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষও। জমি মালিক তথা চাষিদের একাংশও জানাচ্ছেন, চাহিদা মতো জমির দাম না পেলে তাঁরাও জমি ছাড়বেন না।

কিন্তু মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন এই জমি সমস্যার কথা মানতে চায়নি। বরং ঠিকাদার সংস্থার বিরুদ্ধে কাজে গাফিলতির অভিযোগ তুলে জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলছেন, ‘‘বাইপাসের জন্য জমি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। অধিগৃহীত সমস্ত জমি তুলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হাতে। বার বার বলা সত্ত্বেও ওই ঠিকাদার সংস্থাই কাজ শুরু করছে না। আসলে ওদের নিজস্ব কোনও সমস্যা ঢাকতেই জমিজটের অজুহাত দিয়ে রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’’ বহরমপুরের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বাইপাস তৈরি হলে এই শহরে যানজটের সমস্যা আর থাকবে না। জমির মালিক-সহ সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করাটাই জরুরি। তাঁদের আশঙ্কা, সেটা না করে এই চাপানউতোরে শেষপর্যন্ত গোটা প্রকল্পটাই না মাঠে মারা যায়!

জেলা প্রশাসন ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা দিয়েছে, বহরমপুর থেকে ফরাক্কার বল্লালপুর রেলসেতু পর্যন্ত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ১০০.৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বহরমপুরে বাইপাস নির্মাণ হবে ১০.৭৯৮ কিলোমিটার। সারগাছি, খাগড়া ঘাট, মোরগ্রাম ও বল্লালপুরে ৪টি রেলওয়ে উড়ালপুল তৈরি হবে। তৈরি হবে ছোট বড় মিলিয়ে ১৬টি সেতু এবং ১৩৭টি কালভার্টও। গত ৫৪ মাসে ৯০.৪৫ শতাংশ কাজ শেষ করে ইতিমধ্যেই সুতি ও বহরমপুরের কাছে দু’টি জায়গায় টোল আদায়ও শুরু হয়েছে বলে দাবি হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকসন কোম্পানির।

এ দিকে, বহরমপুর বাইপাস নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে থাকায় যানজটের দুর্ভোগে নাজেহাল হতে হচ্ছে নিত্যযাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে গাড়ির চালক সকলকেই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও দাবি করেছেন, এই যানজটের কারণে তাঁদের ব্যবসাও মার খাচ্ছে। শেষপর্যন্ত পুজোর বাজার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই কারণে যানজট রুখতে পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পথে নামছেন বহরমপুরের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বহরমপুরের মতো জমিজটের সমস্যা না থাকলেও ফরাক্কার বল্লালপুর, সুতির আহিরণ ও সাগরদিঘির মোরগ্রামেও কাজ থমকে রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেখোদ জেলা প্রশাসনই।

কিন্তু বহরমপুর বাইপাসের কাজ থমকে কেন?

গত ১৯ অগস্ট ওই ঠিকাদারি সংস্থা, হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকসন কোম্পানির পক্ষ থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়েছে, ‘জমির দাম না পাওয়ায় সড়ক নির্মাণে বাধা দিচ্ছেন জমি মালিকেরা। কাজ শুরুতে এই বিলম্বের জন্য জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষই সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী থাকবেন।’ ওই চিঠির সঙ্গে চাষিদের লিখিত বক্তব্যের ফটোকপিও পাঠিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা। সেই সঙ্গে জমির মালিক, জেলা প্রশাসন ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে দ্রুত বৈঠকে বসে বাইপাসের জমি জট কাটাতেও তারা অনুরোধ করেছে। সংস্থার প্রকল্প ম্যানেজার আশিসকুমার পাণ্ডে বলেন, ‘‘জমিজট তো আছেই। কিছু জমি জলেও ডুবে রয়েছে। মূলত জমি নিয়ে সমস্যার কারণেই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বিষয়টি সবাইকেই জানানো হয়েছে।’’ মালদহের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক প্রকল্পের আধিকারিক সঞ্জীবকুমার শর্মা জানান, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বহরমপুর বাইপাসের জন্য জমির আনুষ্ঠানিক ‘পজেসন’ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। জাতীয় সড়কের আঞ্চলিক অধিকর্তা (কলকাতা) আশুতোষ গৌতম অবশ্য বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কী সমস্যা হয়েছে তার সব কথা আমার পক্ষে সংবাদমাধ্যমের কাছে বলা সম্ভব নয়।’’

জমির মালিকেরা কী বলছেন?

বহরমপুরের পোল্লাডাঙার বদরুল ইসলামের এক বিঘে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বাইপাসের জন্য। তিনি জানান, পোল্লাডাঙার আঁধারমানিক মৌজার সব জমি তিন ফসলি। তিন-চার বার নোটিস পাঠিয়ে তাঁকে ডাকা হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সাহাজাদপুর পঞ্চায়েত অফিসেও তিনি গিয়েছিলেন। তাঁর সাফ কথা, ‘‘এখানকার জমির মূল্য বিঘে প্রতি ৪০ লক্ষ টাকা। অথচ রাজ্য সরকার দিতে চাইছে বিঘে পিছু মাত্র ৭ লক্ষ টাকা। আমাদের চাহিদা মতো দাম না পেলে জমিতে কাউকে নামতে দেব না।’’

ওই গ্রামেরই ইয়াদুল্লা শেখের কথায়, ‘‘জলের দামে আমার ৩২ শতক জমি নিতে চাইছে সরকার। বিঘে পিছু ৪০ লক্ষ টাকা হিসাবে দাম না পেলে এই এলাকার শতাধিক চাষির কেউ টাকা নেবেন না। জমিও দেবেন না। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’’ স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ আলিমের বক্তব্য, ‘‘গ্রামের সকলেই জমির উপরে নির্ভরশীল। এখানকার জমি উঁচু ও তিন ফসলি। ২০০০ সালের বন্যাতেও জমি থেকে ধান পেয়েছি। জমির দাম নিয়ে পাঁচ বার বৈঠক হয়েছে কমিশনার ও জেলাশাসকের সঙ্গে। তাঁদেরও বলেছি, বিঘে পিছু ৪০ লক্ষ টাকা না দিলে জমি দেব না।’’

জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকার রাও অবশ্য জানান, বহরমপুর বাইপাসের জন্য যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে নিয়েছেন। যাঁরা নেননি তাঁদের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। অধিগৃহীত সমস্ত জমি তুলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হাতে। তাই কোথাও কোনও জমির মালিকের কাজে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কাজ করতে গিয়ে যদি কোথাও কোনও বাধা তাঁরা পেয়ে থাকেন তা জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাঁর সংযোজন, ‘‘কাজ করতে গিয়ে বাধা দেওয়ার কোনও চিঠি জাতীয় স়ড়ক কর্তৃপক্ষ কিংবা ঠিকাদারি সংস্থার তরফে আমি এখনও হাতে পাইনি।’’

বহরমপুরের সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি কংগ্রেসের নাজমূল আলম জানান, একসময় বহরমপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তিনি একাধিক বৈঠকে হাজির থেকেছেন। বাইপাসের জন্য শিয়ালমারা ও রানিনগর এলাকার প্রায় সব চাষিই বিঘে প্রতি ৬ লক্ষ টাকা হিসাবে জমি দিয়ে টাকাও নিয়েছেন। সে সব জমি বাস্তবে একফসলি এবং ডোবা। কিন্তু আঁধারমানিক, বাসুদেবখালি এলাকার জমি তিন ফসলি। ওই এলাকার চাষিরা কম দামে জমি দিতে রাজি নন। রাজ্য সরকারের উচিত তাঁদের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ রফায় আসা। না হলে অশান্তির আশঙ্কা যেমন থাকছে, তেমনই পিছিয়ে পড়ছে বহরমপুরে বাইপাস তৈরির কাজও।

অন্য বিষয়গুলি:

Baharampuri Land bypass road
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE