নবদ্বীপ পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের ওলাদেবী তলার হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটা এখন জনশূন্য বললেই চলে। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চের সেই রাতের পর থেকে এ বাড়ির সদস্য সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। সুনসান সেই বাড়িতে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন এক অশীতিপর মা।
দু’ বছর আগে ৩১ মার্চ রাতে এ বাড়িতেই শ্বাসনালি কেটে খুন করা হয়েছিল স্থানীয় পুরসভার কর্মী তথা সিপিএম নেতা অরুণ নন্দীকে। খুনের অভিযোগে মাস দুয়েক আগে গ্রেফতার করা হয়েছে নিহতের স্ত্রী উৎপলা নন্দী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ নবকুমার দত্তকে। তাঁরা এখন জেল হেফাজতেই আছেন। সোমবার ধৃতদের বিরুদ্ধে নবদ্বীপের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ৩৪৪ পাতার চার্জশিট জমা দিল পুলিশ।
প্রতিক্রিয়া জানতে ওলাদেবী তলার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চুপ করে বসে আছেন অরুণবাবুর বৃদ্ধা মা ছবিদেবী। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকেই ৮২ বছরের ওই বৃদ্ধা যেন সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। জোরে কাঁদতেও যেন তিনি ভুলে গিয়েছেন। সারা শরীর সর্বক্ষন কাঁপে। তিনি বলেন, “আমার কি এখনও বেঁচে থাকা উচিত? তবুও আছি আমার অরুণের খুনিদের শাস্তি দেখব বলে। ওরা শাস্তি না পেলে যে অরুণ শান্তি পাবে না। যারা ওকে খুন করেছে তারা শাস্তি পাবেই।”
অরুণবাবুর খুনের পরে দু’ বছর কেটে গিয়েছে। তারপরে এখনও সেই রাতের একটি দৃশ্য কারও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে বুকে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করেন। কেউ আবার কাঁদতে কাঁদতে প্রতীক্ষা করেন অপরাধীর শাস্তির জন্য। সোমবার নবদ্বীপ আদালতে চার্জশিট জমা পড়ার খবরে খুশি অরুণবাবুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ও পড়শিরা। তাঁরা জানান, অরুণবাবুর খুনের ঘটনায় মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু ঘটনার বাইশ মাস পরে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও তার ৬৬ দিনের মাথায় চার্জশিট জমা পড়ায় তাঁরা খুশি।
নবদ্বীপের তেলিপাড়া অঞ্চলে শ্বশুরবাড়ি অরুণবাবুর বড় বোন শুক্লা দাসের। তাঁর কথায়, “দাদা রাজনীতি করলেও এলাকায় কারও সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল না। এটা ভাবতে খুব অসহায় লাগে যে, দাদার খুনে এমন একজনের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠল যাকে দাদা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করত। যার কাছে নিরাপদ মনে করত নিজেকে। পুলিস চার্জশিট দিয়েছে শুনে আমরা খুশি। আশা করছি, দাদার খুনিরা চরম শাস্তি পাবেই।’’ ঘটনার রাতে ছবিদেবীর চিৎকার শুনে প্রথম যিনি ছুটে এসেছিলেন সেই তপন বাগচী অরুণবাবুর ঠিক পাশের বাড়ির বাসিন্দা। তাঁর কথায়, ‘‘সে দিন রাত তিনটে নাগাদ কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম কে যেন আমার নাম করে ডাকছে আর চিৎকার করে কাঁদছে।’’ ঘুম থেকে উঠে তপনবাবু চলে যান অরুণবাবুর বাড়ি। তারপর অরুণবাবুর ঘরে ঢুকে তিনি দেখেন বিছানার উপর পড়ে আছেন অরুণবাবু। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এরপর তিনি অনান্য প্রতিবেশীদের খবরটা জানান। তপনবাবু বলেন, “অরুণদা আমাদের একজন পারিবারিক গাইড ছিলেন। নানা সময়ে ওঁর কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি। সেই মানুষটি এমন ভাবে চলে যাবেন অথচ অপরাধীরা কেউ সাজা পাবে না এটা ভেবে খুব খারাপ লাগত। শেষ পর্যন্ত পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করায় ও দ্রুত চার্জশিট দেওয়ায় এটা ভাবতে ভরসা পাচ্ছি যে, অপরাধীরা দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি পাবে।”
১৯৭৬ সালে নবদ্বীপ কলেজে পড়তে গিয়ে অরুণবাবুর সঙ্গে পরিচয় প্রতিবেশী অশোক সাহার। তারপর থেকে প্রায় চল্লিশ বছরের সম্পর্ক ওঁদের। রাজনীতি এবং কর্মসূত্রে সহকর্মী অরুণবাবু ছিলেন অশোকবাবুর বন্ধু। অশোকবাবু বলেন, “দু বছর পরেও আমি কোনও কোনও রাতে ওই রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠি। তখন বুকে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি। কিছুতেই সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারি না।’’ তিনি জানান, ঘটনার দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একসঙ্গে তাঁরা মিটিং সেরে বাড়ি ফিরেছিলেন। তপনবাবু যখন তাঁকে ডাকে তখন রাত সোয়া তিনটে। তিনি কিছু একটা ঘটেছে ভেবে প্রথমে অরুণবাবুর মোবাইলে ফোন করেন। কিন্তু কেউ ফোনটা না ধরায় তিনি সোজা অরুণবাবুর বাড়ি চলে যান। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সকলের দাবি অরুণের খুনের ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হোক।”
বাবা-মা, তিন বোনকে নিয়ে ছ’জনের সংসার চালাতে চরম লড়াই করেছেন অরুণবাবু। রাতের কলেজে বিকম পড়েছেন। সারাদিন টিউশন পড়িয়েছেন। রেশনের দোকানেও কাজ করেছেন। জীবনে এত সংগ্রাম করেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য সামান্য লড়াই করার সুযোগটুকুও পাননি নবদ্বীপের ডাকসাইটে সিপিএম নেতা অরুণবাবু। তাঁর এই অসহায় ভাবে চলে যাওয়াটা আজও মানতে পারেন না অরুণবাবুর প্রতিবেশী, বন্ধু, পরিজনেরা।
চার্জশিট তো জমা পড়ল, এখন তাঁরা সকলেই অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি চান। অরুণবাবুর আত্মার শান্তির জন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy