প্রতীকী ছবি।
গাঁয়ের গায়ে কাঁটা তারের বেড়া। ও পাড়ে আদিগন্ত বাংলাদেশ। দূরে নদীর রেখা। গ্রামে পা রাখতে গেলে প্রথমে ধুলো ওড়া বালি-পথ, তার পর, বর্ষার স্মৃতি লেপ্টা থাকা কাদা-রাস্তা। শেষে আর পথ নেই ঘাস চিরে পায়ে হাঁটা আড় ভাঙা রাস্তাটা ফিকে হয়ে গেছে গ্রামে, সীমান্তের গ্রাম।
হাজার কয়েক মানুষের সেই সব গ্রামে তেনারা আসেন?
মহখোলার নিলীমা বিশ্বাস বলছেন, ‘‘কে বলেন দেখি ভোট-বাবু? পাঁচ বছরে এক বার!’’ ভুল, নিপাট ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন পড়শি মহিলা। বলছেন, ‘‘কেন গো, তোমার মনে নেই গত দু’টো ভোটে কোন বাবু এসেছিল শুনি!’’
তাঁরা না এসেও আসেন, এসেও আসেন না!
তবু, তাঁদের মিঠে কথা আর ছুটকো-ছাটকা উন্নয়নের একটা তালিকাও পাওয়া যায়, ভোটের মুখে।— দু’টাকার চাল, ওপাড়ের চোটপাটের উপর খবরদারি, গ্রামীণ ইস্কুল। খুব জোরাজুরি করলে শাসক দলের মেজ নেতা দু-গা়ড়ি ভাঙা ইটের খোয়া ফেলে রাস্তাটা পাকা করার বদলে কাজ অসমাপ্ত রেখে একটা ইঙ্গিত ফেলে হারিয়ে যান। তার পর, আবার সব চুপ, আর একটা ভোট-তক।
নদিয়ার এমনই কয়েকটা গ্রাম, কিছু না-পাওয়ার দিনগুজরানে অভ্যস্থ হতে হতে, পাকা রাস্তার স্বপ্ন হারিয়ে শেষতক হারিয়ে গিয়েছে বাঁকা রাস্তায়। চাপড়ার হাটখোলা, মহখোলা, রাঙ্গিরয়ারপোতা, এলাঙ্গি, হুদোপাড়া। বছর কয়েক আগে এই হাটখোলায় পাচারের সময় বিএসএফের গুলিতে মারা গিয়েছিল খুকুলি খাতুন। নিতান্ত ছাত্রী। সেই দিনটা আজও মনে আছে নিলীমার। বলছেন, ‘‘মানুষ কি বাবে যে বেঁচে রয়েছে এখানে, ভোটবাবুরা জেনেও জানেন না। কোন সাহসে যে ভোট চাইতে আসেন!’’ তাঁর গলায় চৈত্রের উষ্মা। বর্ডার রোড ধরে গ্রামের ভিতরে খানিক এগোলে পিচের রাস্তা, মিলিটারির তৈরি করা। পঞ্চায়েত কিংবা পূর্ত দফতরের পা পড়েনা এখানে। অথচ গত বিধানসভার সময়ে গলার শিরা ফুলিয়ে শাসক দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচার করতে আসা এক নেতা কবুল করে গিয়েছিলেন, ‘‘এত দিন হয়নি, এ বার হবে। না হলে আমার নামে কুকুর পুষবেন!’’
নিলীমারা মুচকি হেসে ছিলেন। এখনও মনে পড়লে সে কথা হাসেন।
একইরকম আস্বাস ছিল কর্মসংস্থানের। গ্রামের মানুষ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন পাচারের সঙ্গে তারা আর কোন ভাবেই জড়াবেন না। সাধন বিশ্বাস প্রায় পাঁচ বছর ধরে পরিবার ছেড়ে পড়ে আছেন কাতার। নিলীমা বলছেন, “কোন পরিবারই চায় না তাদের মানুষটা দু’মুঠো ভাতের জন্য বিদেশে পড়ে থাকুক। কিন্তু কি করব বলুন?”
তাঁদের একটাই প্রশ্ন, “এখানে কি কোন ভাবেই এক-আধটা কাজের ব্যবস্থা করা যায় না? যাতে মানুষ গুলোকে আর বাইরে কাজে যেতে না হয়।” ভোট বাবুরা অবশ্য সে আবদার শুনতে পান না। গ্রামের এক বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘ভোটের মুখে ওঁরা যখন আসেন, মুখের হাবভাব দেখে মনে হয়, কী দরদ দিয়েই না শুনলেন, ভোট-বাবুদের এই ভান আর গেল না!’’ তা হলে কি নিছক ভানেই বাঁচে সীমান্ত? সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে স্বীকার করে নিচ্ছেন, খামতি রাজনৈতিক দলগুলির। বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, ভুল বলেননি ওঁরা। আগে আমরা যোগাযোগ রাখতাম, তবে নিত্য অভাব মেটাতে পারিনি। এখন ওঁরা সত্যিই এক ঘরে প্রায়!’’
‘‘তা কেন হবে’’, ঝাঁঝিয়ে উঠছেন তৃমূলের জেলা সম্পাদক গৌরীশঙ্কর দত্ত। বলছেন, ‘‘দেশের রাজ্যের অন্য প্রান্তের মানুষ যে সুযোগ পান ওঁরাও তাই পান, বললে তো হবে না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy