Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

‘মন কি বাত’ শুনেছেন মোদীও, উচ্ছ্বসিত ফরাক্কার বাসিন্দারা

গত পাঁচ বছর ধরে স্কুলের দুরবস্থার কথা জানিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ-সহ বিভিন্ন মহল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েও কোনও কাজ হয়নি। এ দিকে স্কুলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। এরমধ্যে রেডিওতে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এর অনুষ্ঠান শুনে ফরাক্কাক গীতিকা চক্রবর্তী, পুতুল পানির মতো ৭২ জন অভিভাবিকা ঠিক করেন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠালে কেমন হয়! যেমন ভাবা, তেমনই কাজ।

এই স্কুলকে বাঁচানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন অভিভাবিকারা।—নিজস্ব চিত্র।

এই স্কুলকে বাঁচানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন অভিভাবিকারা।—নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা
ফরাক্কা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০২:০৫
Share: Save:

রেডিওতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’ শুনে এলাকার স্কুলের দুরবস্থার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ফরাক্কার জনাকয়েক অভিভাবিকা। সেই চিঠি পেয়েই তড়িঘড়ি ফরাক্কার জেনারেল ম্যানেজারের কাছে ফরাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্ট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘স্টেটাস রিপোটর্’ চেয়ে পাঠাল প্রধানমন্ত্রীর দফতর। পিএমও থেকে পাঠানো ওই চিঠি এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে ব্যারাজের প্রশাসনিক কর্তাদের যে, এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই রিপোর্ট দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।

গত পাঁচ বছর ধরে স্কুলের দুরবস্থার কথা জানিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ-সহ বিভিন্ন মহল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েও কোনও কাজ হয়নি। এ দিকে স্কুলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। এরমধ্যে রেডিওতে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এর অনুষ্ঠান শুনে ফরাক্কাক গীতিকা চক্রবর্তী, পুতুল পানির মতো ৭২ জন অভিভাবিকা ঠিক করেন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠালে কেমন হয়! যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। তবে প্রধানমন্ত্রী যে সেই চিঠির সাড়া দেবেন কিংবা সেই চিঠি নিয়ে এত হইচই পড়ে যাবে তা অবশ্য ভাবতে পারেননি ফরাক্কার ওই মহিলারা।

১৯৬৫ সালে ফরাক্কায় এই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়টি চালু করে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণে এনে বিদ্যালয়টির অনুমোদনও দেয় রাজ্য সরকার। একসময় মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে অন্যতম নামী স্কুল হিসেবে পরিচিতিও পায় এই স্কুলটি। তবে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পেরিয়ে সেই বিদ্যালয় আজ কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুরুতে ৬০ জনেরও বেশি শিক্ষক নিয়ে ১০টি শ্রেণিতে ৪০টিরও বেশি বিভাগ চলত। এখন সেই স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ জন। বিজ্ঞান বিভাগের সমস্ত গবেষণাগার প্রায় বন্ধ। জীববিদ্যা, অঙ্ক, বাংলা বিভাগের কোনও শিক্ষক নেই। রসায়নের শিক্ষক কিছুদিনের মধ্যেই অবসর নেবেন। ইংরেজির শিক্ষকের অভাবে ক্লাস নিতে হচ্ছে স্কুলের অধ্যক্ষকে। প্রাথমিকে ৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ২ জন অবসর নেবেন কয়েক মাসের মধ্যেই। সেই কারণে এ বছর প্রথম শ্রেণিতে কোনও ছাত্র ভর্তি করা হয়নি। বছর পাঁচেক আগেও এই স্কুলের মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। তারপর সেই সংখ্যা ক্রমশ কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১০০। কেন এমন অবস্থা?

স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৬৫ সালে এই স্কুলটি তৈরি করা হয়েছিল ব্যারাজের কর্মীদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথা ভেবে। কারণ সেই সময়েই তৈরি হচ্ছিল ফরাক্কা ব্যারাজ। তখন কর্মী সংখ্যাও ছিল কয়েক হাজার। তারপর ব্যারাজ তৈরি হতেই কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। এখন সবমিলিয়ে হাতেগোনা কিছু কর্মী রয়েছেন। বর্তমানে ওই ১১০০ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যারাজ কর্মীদের ছেলেমেয়ে রয়েছেন দশ শতাংশেরও কম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই স্কুলের এক শিক্ষক জানান, ব্যারাজ কর্মীদের ছেলেমেয়ে ছাড়াও স্থানীয় বহু ছেলেমেয়ে এখানে পড়াশোনা করে। কিন্তু ব্যারাজ কর্মীদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে এই স্কুল নিয়ে তেমন ভাবে আর আগ্রহ দেখাচ্ছিল না জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর। নতুন করে শিক্ষক বা স্কুলের অন্য কোনও কর্মী নিয়োগও বন্ধ হয়ে রয়েছে। আর সেই কারণেই সঙ্কটে পড়েছে একসময়ের নামী স্কুল।

স্কুলের দুরবস্থার কথা মেনে নিয়ে অধ্যক্ষ মনোজকুমার পানি জানান, স্কুলের সঙ্কটের কথা জানিয়ে দিল্লিতে একাধিকবার চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ফরাক্কা ব্যারাজের জেনারেল ম্যানেজার সৌমিত্রকুমার হালদার জানান, স্কুলের এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে সম্প্রতি দিল্লিতে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসা চিঠি নিয়ে বিশদে জেনারেল ম্যানেজার কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও ফরাক্কা ব্যরাজের এক পদস্থ কর্তা জানান, ফরাক্কা ব্যারাজ স্কুলের এমন বেহাল দশার কথা জানিয়ে স্থানীয় কিছু অভিভাবিকা চিঠি পাঠিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই। সেই চিঠির উল্লেখ করেই তাঁদের অফিসে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে স্কুল সম্পর্কে রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়। ওই কর্তা বলেন, “ওই স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে রিপোর্ট নিয়ে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।” সেই রিপোর্টে স্কুলের যাবতীয় সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয় অভিভাবিকা গীতিকা চক্রবর্তী জানান, এই স্কুলের সঙ্গে তাঁদের তিন প্রজন্মের সম্পর্ক। চোখের সামনে স্কুলটিকে এ ভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। তারপরেই সকলে মিলে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেন। আর একজন অভিভাবিকা পুতুল পানি ওই স্কুলের অধ্যক্ষেরই স্ত্রী। তাঁর দুই ছেলে ওই স্কুলে পড়াশোনা করে। পুতুলদেবী জানান, স্কুলের পঠনপাঠন রাজ্য সরকারের বোর্ডের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হলেও নিয়োগ ও পরিকাঠামোগত বিষয়গুলি দেখভাল করে কেন্দ্রীয় সরকারের জলসম্পদ মন্ত্রক। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ওই দফতরের মন্ত্রী উমা ভারতী এসেছিলেন ফরাক্কায়। তাঁর কাছেও জানানো হয় স্কুলের অবস্থার কথা।

গীতিকাদেবী ও পুতুলদেবী বলছেন, “আমাদের কথা যে প্রধানমন্ত্রীর মন ছুঁয়েছে সেটা ভাবতেই খুব ভাল লাগছে।” স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হরিশ রায় জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জেলার মধ্যে বহু বার প্রথম হয়েছে ফরাক্কা ব্যারাজের স্কুলের ছেলেমেয়েরা। তিনি নিজেও অধ্যক্ষ থাকাকালীন বেশ কয়েকবার দিল্লিতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। “আমি যা পারিনি তা পেরেছেন স্কুলের ওই অভিভাবিকারা। দেখবেন, এ বার স্কুলের সব সমস্যা মিটে যাবে। সবকিছু ফের আগের মতো হবে।” উচ্ছ্বসিত হরিশবাবু।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE