Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসনের

টাকা খরচ করেনি স্কুল, বেতন বন্ধ শিক্ষকদের

কোনও স্কুল কতৃর্পক্ষ সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা খরচ করতে পারেননি। বছরের পর বছর সেই টাকা পড়ে রয়েছে ব্যাঙ্কে। কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষ আবার টাকা খরচ করলেও জমা দেননি ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’। বার বার ওই স্কুলগুলিকে সতর্ক করেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল নদিয়া জেলা প্রশাসন।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:২৩
Share: Save:

কোনও স্কুল কতৃর্পক্ষ সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা খরচ করতে পারেননি। বছরের পর বছর সেই টাকা পড়ে রয়েছে ব্যাঙ্কে। কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষ আবার টাকা খরচ করলেও জমা দেননি ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’। বার বার ওই স্কুলগুলিকে সতর্ক করেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল নদিয়া জেলা প্রশাসন।

অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উৎপল ভদ্র বলেন, “গত এক বছর ধরে নানা ভাবে স্কুলগুলিকে টাকা খরচের কথা বলা হয়েছিল। স্কুলগুলো যাতে সঠিক ভাবে টাকা খরচ করতে পারে তার জন্য আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে নানা ভাবে সহযোগিতাও করেছি। কিন্তু তার পরেও যে স্কুলগুলি সতর্ক হয়নি তাদের বিরুদ্ধেই বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ করতে হল।”

জেলা প্রশাসনের দাবি, এই নতুন ‘দাওয়াই’য়ে ফলও মিলতে শুরু করেছে। ডিসেম্বর থেকে বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টনক নড়েছে স্কুল কতৃপক্ষের। বার বার বলেও যাঁদের সাড়া মেলেনি, এখন সেই সব স্কুল কতৃর্র্পক্ষই ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দিতে শুরু করেছে। কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্কে পড়ে থাকা টাকা সুদ-সহ ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার দ্রুত কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিখিত মুচলেকাও দিয়েছেন।

নদিয়া জেলায় প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ২৬১৪টি এবং জুনিয়র ও হাইস্কুলের সংখ্যা ৬২০টি। টাকা খরচ না করে ফেলে রাখা, কাজ অসম্পূর্ণ রাখা কিংবা ইউসি জমা না দেওয়া প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৮০ টি এবং জুনিয়র ও হাই স্কুলের সংখ্যা ৩৩টি। জুনিয়র ও হাইস্কুলের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হলেও প্রাথমিক স্কুলগুলিকে আরও এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। এই একমাসের মধ্যে টাকা খরচ করে ইউসি জমা না দিতে পারলে ওই স্কুলগুলির বিরুদ্ধে একই পদক্ষেপ করা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। জেলার স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) কৌশিক রায় বলেন, “নানা ভাবে সতর্ক করে, চাপ দিয়েও স্কুল কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। শেষ পর্যন্ত বেতন বন্ধ করাতেই এখন কাজ শুরু, টাকা ফেরত কিংবা ইউসি জমা দেওয়ার ধুম লেগেছে। সেই স্কুলের বেতন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।”

জেলা সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সাল থেকে জেলার বহু স্কুলে সর্বশিক্ষা মিশনের বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ না হয়ে পড়েছিল। গত বছর থেকে সেই সব স্কুল গুলিকে চিহ্নিত করে সতর্ক করা হচ্ছিল। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, খরচ না হয়ে এতদিন প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা পড়েছিল। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই টাকার প্রায় ১৮ কোটি টাকা স্কুলগুলোর কাছ থেকে ফেরত নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের এই ক’দিনে আরও প্রায় ১ কোটিরও বেশি টাকা ফেরত এসেছে।

স্কুলগুলিকে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ, শৌচাগার, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ শৌচাগার, র্যাম্প ও হাতল তৈরির জন্য প্রতি বছরই টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে সেই টাকা খরচ না করে ফেলে রেখেছিল স্কুলগুলি। কিন্তু কেন ওই স্কুলগুলি টাকা খরচ করেনি? জেলা প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, “এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির পাশাপাশি পরিচালন সমিতিতেও নানা সমস্যা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শ্রেণিকক্ষ বা শৌচাগার তৈরির মতো উপযুক্ত জায়গার অভাব।” ওই কর্তার যুক্তি, “এক্ষেত্রে শিক্ষকদের গাফিলতিই সব থেকে বড় কারণ। ওই স্কুলগুলি যখন টাকা খরচ করতে পারল না, তখন সেই টাকা ব্যাঙ্কে ফেলে না রেখে ফিরিয়ে দিল না কেন?”

চাকদহের ইছাপুর আদিবাসী হাই স্কুলের শৌচাগার তৈরির টাকা পড়ে রয়েছে ২০১১ সাল থেকে। পরে প্রশাসনের চাপে ওই স্কুল শৌচাগার নির্মাণ করলেও ইউসি জমা দিতে পারেনি।” প্রধানশিক্ষক রঞ্জিত দাস বলেন, “নানা কারণে কাজটা করে উঠতে পারিনি।” শান্তিপুরের দু’টি স্কুল টাকা খরচ করতে না পেরে চাপে পড়ে সুদ-সহ সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। শান্তিপুর হিন্দু স্কুলেও ২০১১ সাল থেকে টাকা পড়ে আছে। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের স্কুলে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ তৈরির জায়গা নেই। তাছাড়া এর আগের স্কুল কর্তৃপক্ষ টাকা খরচের বিষয়টি নিয়ে সে ভাবে সক্রিয়ও ছিলেন না।”

শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল একাডেমিতেও ২০১১ সাল থেকে শ্রেণিকক্ষ তৈরির টাকা পড়ে রয়েছে। সুদ-সহ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে এই স্কুলটিও। প্রধানশিক্ষক পবিত্র নাথ বলেন, “২০১০ সাল থেকে আমাদের স্কুলে পরিচালন সমিতি নেই। পরে প্রশাসক নিয়োগ হলেও সময়ের অভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি।” আবার ফাজিলনগর হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক সিদ্দিক রহমান বলেন, “আমাদের স্কুলেও ২০০২ সাল থেকে পরিচালন সমিতি ছিল না। ফলে আমরাও সর্বশিক্ষা মিশনের কোনও টাকাই খরচ করতে পারিনি। পরিচালন সমিতি তৈরি হওয়ার পরে ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে আমরা সমস্ত কাজ শুরু করি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ইউসি জমা দিতে পারিনি।’’

বেশ কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ টাকা ফেলে রাখার পরে প্রশাসনের চাপে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, নির্মাণ কাজের খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তাই পরে তাঁরা কাজ করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। তাঁরা টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এ ভাবে কি সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা খরচ করতে না পারার জন্য শিক্ষকদের বেতন আটকে দেওয়া যায়? প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকরাই। যদিও কৌশিকবাবু বলেন, “সরকারি অর্থে স্কুল চলে। ফলে সরকারি নির্দেশিকা না মানলে তো আমাদেরও কড়া অবস্থান নিতেই হবে। আর আমরা সেটা করতেও পারি।”

অন্য বিষয়গুলি:

susmit haldar krishnanagar salary teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE