Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

ঐতিহ্য ভবন ভেঙে কৃষ্ণনগরে উঠছে অবৈধ বহুতল

গ্রামটার নাম ছিল রেউই। মহারাজা রাঘবচন্দ্র মার্টিয়ারির রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এই গ্রামে এসে বিরাট এক প্রাসাদ তৈরি করলেন। পরে তাঁর ছেলে রুদ্র রায় গ্রামের নাম বদলে রাখলেন কৃষ্ণনগর (কৃষ্ণ ভক্ত গোপদের বাস বেশি বলেই হয়তো)। শুধু নাম নয়, কালের স্রোতে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে পুরো খোলনলচেটাই বদলে গিয়েছে কৃষ্ণনগরের। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরে জমির দাম বাড়ছে হু হু করে। জমি কিনে বাড়ি করাটা মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। চাহিদা বাড়ছে ফ্ল্যাটবাড়ির।

একদা এখানেই ছিল লালবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

একদা এখানেই ছিল লালবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০২:০৯
Share: Save:

গ্রামটার নাম ছিল রেউই। মহারাজা রাঘবচন্দ্র মার্টিয়ারির রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এই গ্রামে এসে বিরাট এক প্রাসাদ তৈরি করলেন। পরে তাঁর ছেলে রুদ্র রায় গ্রামের নাম বদলে রাখলেন কৃষ্ণনগর (কৃষ্ণ ভক্ত গোপদের বাস বেশি বলেই হয়তো)। শুধু নাম নয়, কালের স্রোতে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে পুরো খোলনলচেটাই বদলে গিয়েছে কৃষ্ণনগরের। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরে জমির দাম বাড়ছে হু হু করে। জমি কিনে বাড়ি করাটা মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। চাহিদা বাড়ছে ফ্ল্যাটবাড়ির। প্রোমোটারদের লোলুপ চোখ ঘুরে বাড়াচ্ছে শহরের সর্বত্র। পুরনো

বাড়ির খোঁজে।

শহরের পত্তন অবশ্য রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে। তাঁতিপাড়া, খোট্টাপাড়া, আমিনবাজারের মতো পেশা ভিত্তিক মহল্লা গড়ে বৃদ্ধি সামন্ততান্ত্রিক এই শহরের। এরই মধ্যে কৃষ্ণনগরে এসে বসবাস শুরু করে দিয়েছে ইংরেজ। তখন সড়কপথ এত উন্নত ছিল না। জলপথই ছিল পণ্য পরিবহনের প্রধান উপায়। সেই হিসাবে তখন জলঙ্গি নদী ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীর ধারে ইংরেজরা বন্দরের পত্তন করল। আজ যেখানটা গোলাপট্টি নামে পরিচিত সেই এলাকায় বন্দরের কাছে একাধিক গোলা বা গুদাম তৈরি হল। এই গোলাপট্টির পাশেই তৈরি হল শহরের বাণিজ্য কেন্দ্র গোয়াড়িবাজার (বন্দর এলাকা থেকে পণ্য পরিবহণ হত গরুর গাড়ির মাধ্যমে, সেই থেকে নামকরণ)। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বন্দর বা বাণিজ্যকেন্দ্রকে ঘিরে গঠিত হতে শুরু করে এক নতুন বসতি।

একদিকে অঞ্জনা ও জলঙ্গি নদীর সংযোগ স্থলে বসবাস করতে শুরু করল নীলকররা। অন্য দিকে শহরের আর এক প্রান্তে নিজের মত করে গড়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছে ঘূর্ণী এলাকা। এই ভাবে আস্তে আস্তে কৃষ্ণনগরের কলেবর বাড়তে থাকল। তৈরি হল রেসকোর্স, মিস মরিয়মের সুদৃশ্য ইউরোপীয় হোটেল। ১৯২০ সালে কৃষ্ণনগরের প্রায় ৩০ হাজার নাগরিকের জন্য প্রতিষ্ঠা হল জলকল। ১৯৩৬ সালে শুরু হল বিদ্যুৎ সরবরাহ। এরই মধ্যে আদালত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে কৃষ্ণগরের জনজীবনে এক পরিবর্তন নেমে এল। আদালতে মামলার জন্য অবিভক্ত নদিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান ধরনের মানুষ আসতে শুরু করলেন এই শহরে। তাঁদের অনেকেই এই শহরে বাড়ি তৈরি করলেন। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমিদাররা এই শহরে বাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন। যাঁরা আর্থিক ভাবে তুলনায় দুর্বল, তাঁরা শহরের প্রান্তিক এলাকায় বাড়ি করলেন। তাতে শহর যেমন জমজমাট হতে শুরু করল তেমনই শহরের পরিধি বাড়তে থাকল। এই ভাবেই কৃষ্ণনগর নিজের মতো করে তৈরি হতে থাকল।

কিন্তু দেশভাগের পর দলে দলে উদ্বাস্তুরা এসে জড়ো হল এই শহরে। শহরের অন্যতম প্রবীণ নাগরিক তথা কৃষ্ণনগরেরে বিবর্তণের ইতিহাসের রচয়িতা চন্দন সান্যাল বলেন, ‘‘সেই সময়ই শহরের দুই প্রান্তে দু’টি বড় বড় জনবসতি তৈরি হল। শহর যেন একটা নতুন রূপ নিল।’’

উদ্বাস্তুরা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করে নিলেন। রীতিমতো সমবায় করে শক্তিনগর ও কালীনগর এলাকায় তাঁরা বসতি স্থাপন করলেন। আরও কলেবরে বাড়ল শহর। জলঙ্গি নদীর ধারে নগেন্দ্রনগরেও জনবসতি তৈরি হতে থাকল। শহর যত বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনসংখ্যা, বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট। দোকান-পাটের চাপে রাস্তা-ঘাট ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হতে শুরু করেছে। আর তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে আবাসনের সংখ্যা।

শহরের ভিতরে একের পর এক পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে এই সব ফ্ল্যাট বাড়ি। কৃষ্ণনগর শহরের অন্যতম ঐতিহ্যশালী বাড়ি ছিল সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের স্মৃতি জড়িত লালবাড়ি। কৃষ্ণনগরের প্রাণকেন্দ্র পোস্ট অফিস মোড়ে এই লালবাড়ির সঙ্গে শহরের মানুষের এক অন্য রকম আবেগ জড়িত ছিল। সেই লালবাড়ি ভেঙে চোখের লামনে বহুতল তৈরি হতে দেখে স্পষ্টতই হতাশ হয়ে যান শহরের মানুষ। একই ভাবে চাষাপাড়া মোড়ে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যালের বাড়িও আজ নেই। সেখানে তৈরি হয়েছে ঝাঁ-চকচকে দোকান-বাজার। এই ভাবেই কৃষ্ণনগর শহর থেকে একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরনো আমলের একাধিক বাড়ি।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা কৃষ্ণনগর নাগরিক কমিটির প্রাক্তন সভাপতি আকুলানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনেকেই তাদের বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না। তাঁরা সেই পুরনো বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। সেই সব বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে আবাসন।”

ঐতিহ্যের বিলুপ্তির মাঝেই আবার লুকিয়ে বিপদের ঘণ্টা। কারণ নতুন তৈরি বাড়ির অধিকাংশই নিয়ম মেনে হচ্ছে না। এই মুহুর্তে কৃষ্ণনগর পুরসভা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫টির মতো ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয়েছে। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সদর মোড়ে এমনই এক ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। পুরসভা থেকেই জানানো হচ্ছে, এই ফ্ল্যাটবাড়িটি আইন মেনে তৈরি হয়নি। চার দিকে যে পরিমাণ জায়গা ছাড়া উচিত সেটা ছাড়া হয়নি। এছাড়াও ওই ফ্ল্যাটটি নিয়ে একাধিক বিষয়ে আপত্তি আছে পুরসভার। তাহলে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুরসভা? পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন, ‘‘ওই ফ্ল্যাটটি আগের বোর্ডের সময়ে তৈরি। আমরা সেই সময় ওই নির্মাণ ভেঙে ফেলতে বলেছিলাম। ওরা কথা শোনেনি। আমরা ওদের কম্পিলশন সার্টিফিকেট দেইনি।’’ তিনি আরও বলেন,‘‘ওই আবাসনে যারা বসবাস করছেন তাঁরা কিন্তু বে-আইনি ভাবে আছেন। তাঁদের মিউটেশন নেই। অনুমোদন নেই।’’

পুর-কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রথম দিকে তৈরি হওয়া কয়েকটি আবাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা থাকলেও এখন অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নিচ্ছে পুরসভা। পুরসভা অনুমোদিত নকশা মেনে আবাসন তৈরি না করায় পাত্রবাজার, সদর হাসপাতালের পিছনে মিমি হলের পাশে একাধিক আবাসন নির্মাণের সময় তা ভেঙে দিয়েছে পুরসভা। অসীমবাবুর দাবি, ‘‘ওই সব আবাসনের ক্ষেত্রে আমরা যে নকশার অনুমোদন দিয়েছিলাম, সেই মতো নির্মাণ হচ্ছিল না। আমরা তাই ভেঙে দিয়েছিলাম। পরে আমাদের শর্ত অনুযায়ী আবাসন নির্মাণ করেছে ওরা।’’ কিন্তু আইন না মেনে অনেক আবাসনেই যে সাব-মার্সিবল পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে? অসীমবাবু বলেন, ‘‘আমরা সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর অনুমতি দিইনি। কেউ যদি করে থাকে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’’ ব্যবস্থা আর কত জনের বিরুদ্ধে? আইন ভাঙার খেলা চলছে শহরজুড়েই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE