লোকসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে নির্দেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। —ফাইল ছবি
শুরু হয়ে গেল তৃণমূলের ‘ওয়ার্ম-আপ’। শুক্রবার তৃণমূল ভবনে দলের ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হল। সে বৈঠকে তৃণমূল চেয়ারপার্সনের প্রধান বার্তা, এখন থেকেই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে হবে বিজেপির বিরুদ্ধে। দেশের প্রায় সব বিরোধী দলকে আগামী ১৯ জানুয়ারি যে কর্মসূচিতে হাজির করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই ব্রিগেড সমাবেশের চোখধাঁধানো সাফল্যের জন্য এই মুহূর্ত থেকে প্রস্তুত হতে বললেন দলকে। সংগঠনে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ রদবদলও ঘটালেন। সে রদবদলে বাড়ল শুভেন্দু-অভিষেকের ক্ষমতা, খর্ব হলেন বক্সি-পার্থ।
পঞ্চায়েত নির্বাচন মেটার পর পরই কোর কমিটির বর্ধিত বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অধিকাংশ দলের ক্ষেত্রে কোর কমিটি বৈঠকের অর্থ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বৈঠক। কিন্তু তৃণমূলের কোর কমিটি বৈঠক ছোটখাট সভার চেহারা নিয়ে নেয়। কয়েক মাস আগের কোর কমিটি বৈঠকটি তাই নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে করতে হয়েছিল। শুক্রবারের কোর কমিটি বৈঠক বর্ধিত বৈঠক ছিল না। দলের সর্বভারতীয় এবং রাজ্য কমিটির পদাধিকারীরা, রাজ্য মন্ত্রিসভার সব সদস্য, সব সাংসদ, সব বিধায়ক (বিধানসভায় টিকিট পেয়ে যাঁরা জিততে পারেননি, তাঁরাও), জেলা পরিষদগুলির সভাধিপতি এবং সহ-সভাধিপতিরা, পুরসভাগুলির চেয়ারম্যানরা, দলের জেলা নেতৃত্ব, ব্লক নেতৃত্ব, শাখা সংগঠনগুলির নেতৃত্ব— এঁদেরই বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। তৃণমূল ভবনের সবচেয়ে বড় হলটিতে বৈঠক হয়। দলকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা— বিজেপি যেন একটি আসনও না পায় রাজ্যে।
বৈঠক শেষে যে সাংবাদিক সম্মেলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেন, সেখানে তিনি নিজেই সে আভাস দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা চাইব আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সম্পূর্ণ পরাস্ত হোক, চূড়ান্ত ভাবে পরাস্ত হোক। বাংলা থেকে একটা আসনও যেন বিজেপি না পায়।’’
আরও পড়ুন: ‘টাকা তো দিয়ে দিয়েছি, ফেরত আনব কী করে’, বললেন মমতা
গত ২১ জুলাই ধর্মতলায় শহিদ স্মরণ সমাবেশের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে সমাবেশ করবেন তিনি। সেই সমাবেশে বিজেপি-বিরোধী সব দলকেই যে তিনি আমন্ত্রণ জানাবেন তা-ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই ঘোষণা যে একেবারেই কথার কথা নয় এবং ওই সমাবেশ মঞ্চকে যে তিনি জাতীয় রাজনীতির একটি ভরকেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছেন, সে কথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানান, ব্রিগেড সমাবেশের জন্য দেশের বিভিন্ন বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানানো ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবাল, জম্মু-কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লা, অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নায়ডুরা আসার ব্যাপারে সম্মতিও জানিয়ে দিয়েছেন বলে মমতা এ দিন জানান। সনিয়া-রাহুল, অখিলেশ-মায়াবতী বা স্ট্যালিন— আমন্ত্রিতদের তালিকাও খানিকটা জানিয়ে দেন তিনি। সেই তালিকায় দু’টি নাম বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একটি হল উদ্ধব ঠাকরে— যিনি বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়ালেও এখনও এনডিএ-তেই রয়েছেন। আর একটি হল কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য পিনারায়ি বিজয়ন। সিপিএম তাঁর নামে নিন্দা-মন্দ করে তিনি জানেন, তা সত্ত্বেও জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে ব্রিগেডের সমাবেশে তিনি কেরলের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার এমনই জানিয়েছেন।
ব্রিগেড সমাবেশেকে কী রকম চেহারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিতে চাইছেন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রস্তুতি সংক্রান্ত নির্দেশ থেকেই। এ দিনের বৈঠকে ব্রিগেড সমাবেশের জন্য একটি ‘পাবলিসিটি ক্যাম্পেন কমিটি’ গড়ে দিয়েছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। সেই কমিটির কনভেনর করা হয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকে। কো-কনভেনর করা হয়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
আরও পড়ুন: কাউন্সিলররা নিখোঁজ? জ্যোতিপ্রিয়-অর্জুন দ্বন্দ্বে রহস্য জমজমাট হালিশহরে
শুধু ব্রিগেড সমাবেশের জন্য নয়, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েও যে শুভেন্দু আর অভিষেকের উপরেই সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখতে চাইছেন মমতা, এ দিনের বৈঠকে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সুব্রত বক্সি এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ডানা ছাঁটা হয়েছে অনুচ্চারিত ভঙ্গিতে। যে সব জেলার সাংগঠনিক দায়িত্ব সুব্রত ও পার্থর উপরে ছিল, সেই জেলাগুলিতেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে শুভেন্দু বা অভিষেককে। ঝাড়গ্রাম এবং নদিয়ার দায়িত্ব এত দিন ছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উপরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন জানিয়েছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ বার থেকে শুভেন্দু অধিকারীও দেখভাল করবেন ওই জেলাগুলিতে তৃণমূলের সাংগঠনিক কার্যকলাপ। পশ্চিম মেদিনীপুর এবং কোচবিহার দেখছিলেন সুব্রত বক্সি। পশ্চিম মেদিনীপুরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শুভেন্দুকে, কোচবিহারে অভিষেককে। দক্ষিণ দিনাজপুরের দায়িত্বও ছিল সুব্রত বক্সির হাতে। সেখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ফিরহাদ হাকিমকে।
মমতার নির্দেশে দলে আরও গুরুত্ব বাড়ছে শুভেন্দু অধিকারীর। —ফাইল ছবি
শুভেন্দু এবং অভিষেকের মতো না বাড়লেও, বেশ কিছুটা বেড়েছে ফিরহাদ হাকিমের গুরুত্বও। শুধু দক্ষিণ দিনাজপুর নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাংগঠনিক পর্যবেক্ষকও করা হয়েছে তাঁকেই। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে সরানো হবে, এ গুঞ্জন অনেক দিন ধরেই ছিল। এ দিন কোর কমিটির বৈঠক শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের নতুন সভাপতি হয়েছেন শুভাশিস চক্রবর্তী। তিনি আরও জানান, শোভন যেমন জেলাটা দেখছিলেন, তেমনই দেখবেন। সঙ্গে থাকবেন ববি। আর তাঁদের সাহায়্য করার জন্য কো-অবজার্ভার হিসেবে থাকবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে গুরুত্ব বাড়ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। —ফাইল ছবি
কোর কমিটির বৈঠকে এ দিন দুই জেলা সভাপতি প্রশংসিত হয়েছেন বলেও তৃণমূল সূত্রের খবর। তাঁরা হলেন বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল এবং উত্তর ২৪ পরগনার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এই দুই সভাপতি নিজেদের জেলায় যে কোনও সাংগঠনিক সমস্যা নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারেন, শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় না, বাকিরা কেন পারেন না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই প্রশ্ন তোলেন। জ্যোতিপ্রিয় এবং অনুব্রত যে ভাবে দল চালাচ্ছেন, বাকিদেরও তা অনুসরণ করতে হবে— তৃণমূলনেত্রী এ দিন এমন পরামর্শই দেন বলে জানা গিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনের আগে সংগঠনের চেহারাটা কেমন হচ্ছে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে কাদের উপরে তিনি ভরসা রাখতে চাইছেন, তা স্পষ্ট করে দিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘‘দাঙ্গা লাগানোই হল বিজেপির সংস্কৃতি।’’ পুজোর মরসুমে অশান্তি বাঁধানোর চেষ্টা হতে পারে, কিন্তু কোনও প্ররোচনার ফাঁদে পা দিলে চলবে না— এ দিন এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরএসএস-কেও এ দিন তীব্র আক্রমণ করেছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। তিনি বলেন, ‘‘আরএসএস-কে কোনও দিন এত জঘন্য রাজনীতি করতে দেখিনি। আরএসএসের কাছ থেকে এটা আশা করি না।’’ সঙ্ঘ এখন সামাজিক কাজ ছেড়ে রাজনীতি করতে নেমেছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন এ দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy