মাঝ-নভেম্বরে আলিপুর থানায় তাণ্ডব থেকে মাথা বাঁচাতে ফাইলপত্রকে ঢাল করে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়েছিলেন পুলিশকর্মী। মাস আড়াইয়ের মাথায়, বুধবার মহানগরে আবার আক্রান্ত হল কলকাতা পুলিশ। এই আড়াই মাসের মধ্যেও অবশ্য খাস কলকাতা এবং জেলায় বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কিছু পুলিশকর্মীকে মারধর খেতে হয়েছে। এ দিন তার পুনরাবৃত্তিতে মহানগর-সহ রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের দক্ষতা ফের প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল।
ঠিক কী ঘটেছে এ দিন?
পুলিশ জানায়, ক্রমাগত জাল মোবাইল বিক্রির অভিযোগ আসতে থাকায় এ দিন বিকেলে ওয়াটগঞ্জ এলাকার ফ্যান্সি মার্কেটে তদন্ত করতে গিয়েছিল গুন্ডা দমন শাখা। তখনই ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের হাতে বেধড়ক মার খান কলকাতা পুলিশের ছ’জন কর্মী। তাঁদের মধ্যে তিন জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
তিনটি গাড়ি নিয়ে হানা দিয়েছিল পুলিশ। অভিযানের মধ্যেই নকল মোবাইল বিক্রির অভিযোগে রাজ নামে এক ব্যক্তিকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। ইতিমধ্যে বাজারের লোকজন জড়ো হয়ে যায়। ধৃত রাজকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে কয়েক জন পুলিশকর্মী ঘটনাস্থল থেকে বেরোতে পারলেও পুলিশের অন্য দু’টি গাড়িকে আটকে দেয় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ। তার পরে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে ক্ষিপ্ত জনতা। পুলিশকর্মীদের রাস্তায় ফেলে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়। সমানে চলতে থাকে কিল-চড়-লাথি। গুরুতর আহত হন কলকাতা পুলিশের এআরএসের ওসি সৌম্য ঠাকুর, সাব-ইনস্পেক্টর প্রসূন দে সরকার-সহ ছ’জন। তাঁদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তিন জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তিন জন পুলিশকর্মী ভর্তি রয়েছেন।
প্রশ্ন উঠছে, এমনটা কেন হল? বিশেষ করে কিছু দিন আগেই যখন আলিপুর থানার হামলায় পুলিশের মুখ পুড়েছিল, এ দিন তারা যথেষ্ট তৈরি হয়ে যায়নিই বা কেন?
পুলিশের বক্তব্য থেকে যা জানা যাচ্ছে, সেটা আরও বেশি লজ্জার। কারণ, সেই ঘটনায় মহানগরে তদন্তে এসে ভিন্ রাজ্যের অফিসারদেরও মারধর খেতে হয়েছিল। পুলিশ জানায়, ফ্যান্সি মার্কেটে বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল, ট্যাব নকল করে বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেই অভিযোগ পৌঁছে গিয়েছে অন্য রাজ্যেও। তারই ভিত্তিতে মাসখানেক আগে দিল্লি আদালতের নির্দেশে সেখানকার এনফোর্সমেন্টের ব্রাঞ্চের ছ’জন অফিসার ওই বাজারে অভিযান চালাতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল কলকাতা পুলিশের একটি দল। তা সত্ত্বেও সেই অভিযানে ফ্যান্সি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের একাংশের হাতে পিটুনি খেতে হয় পুলিশকে। শেষ পর্যন্ত মারমুখী জনতার তাড়া খেয়ে অভিযান বন্ধ রেখেই ফিরে যেতে বাধ্য হন দিল্লির তদন্তকারীরা।
ফিরে গিয়ে ওই হামলার ব্যাপারে দিল্লি আদালতে রিপোর্ট পেশ করে সেখানকার এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের দলটি। কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ ওঠে দিল্লি আদালতে। অভিযানে নেমে ভিন্ রাজ্যের পুলিশকে কেন আক্রমণের মুখ পড়তে হল, সেই বিষয়ে রিপোর্ট তলব করেন বিচারক। তিনি সমনও পাঠান কলকাতা পুলিশের বেশ কয়েক জন অফিসারের বিরুদ্ধে।
ইতিমধ্যেই জাল মোবাইল তৈরির একটি চক্র সক্রিয় বলে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে কলকাতা পুলিশ। এ দিন তার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখার কর্মী-অফিসারেরা ফ্যান্সি মার্কেটে হানা দেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পরেই গোলমাল বাড়ে। ধৃত রাজ এক মাস আগে দিল্লির অফিসারদের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনাতেও নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
এ দিনের ঘটনার পরে আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, তদন্তে নামা পুলিশকে খুনের চেষ্টা, গাড়ি ভাঙচুর এবং অন্যান্য অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ওয়াটগঞ্জ থানায়।
প্রশ্ন উঠছে, যে-পুলিশ নিজেদেরই রক্ষা করতে পারে না, বারংবার মার খেয়ে ফিরে যায়, তারা জনগণের জান-প্রাণ-সম্পত্তি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে কী ভাবে?
পুলিশকর্তারা মুখ খুলছেন না। তবে পুলিশেরই নিচু তলার ক্ষোভ, রাজনীতির খবরদারিতে বাহিনীর আত্মবিশ্বাস টাল খেয়ে গিয়েছে। তাই এ ভাবে মার খেতে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy