দৌড় শুরুর হুইসল বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পড়ে গেলে তুলে ধরার হাতটা রাখা হয়নি। সেই কারণেই কি অসময়ে হারিয়ে যাচ্ছে অনুরাগ বসাকের মতো এক-একটা জীবন? শুক্রবার দুপুরে বাগুইআটির এক স্কুলের ছাদ থেকে পড়ে অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা এমনই নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে।
মনোবিদদের মতে, প্রতি মুহূর্তে এই প্রজন্মকে সাফল্যের জন্য তৈরি করছেন বাবা-মায়েরা। শুধু পড়াশোনা নয়, সব ক্ষেত্রেই যেন তারা জেতে! জেতাটাই যে আসল, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে স্কুল, স্কুলের শিক্ষক, পরিপার্শ্ব। তাই না পাওয়ার স্বাদটা কেমন, ব্যর্থতার পরেও কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কী ভাবে এক হার থেকে অপেক্ষা করতে হয় পরের জিতের জন্য, তা ওদের অনেকেরই শেখা হয়ে উঠছে না। তাই পরীক্ষার খারাপ ফল, বাবা-মায়ের বকুনি কিংবা প্রেমে ব্যর্থতার মতো যে কোনও আপাত তুচ্ছ কারণই ওদের কারও কারও কাছে হয়ে পড়ছে জীবনে দাঁড়ি টানার উপযুক্ত যুক্তি।
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। কলকাতার এক স্কুলে গিয়ে সেখানকার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের কাউন্সেলিং করেছিলেন তাঁরা। প্রথমে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা, তার পরের পর্বে বাবা-মায়েদের সঙ্গে। পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলার পরে তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘বাবা-মায়েদের কাছে আমাদের মাধ্যমে বলার জন্য তোমাদের কি বিশেষ কোনও কথা আছে?’ প্রথমে ফিসফিস, গুনগুন, তার পরে বিশাল হল-এর প্রায় শ’তিনেক ছেলেমেয়ে কার্যত সমস্বরে বলেছিল, ‘‘প্লিজ টেল দেম টু লিসন টু আস।’ অর্থাৎ, ‘ওদের বলুন, ওরা যেন আমাদের কথাটা শোনে।’
প্রশ্ন হল, বাবা-মায়েদের সঙ্গে কি কথা হয় না এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের? হয় তো! ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়ার আগে তাদের সঙ্গে কথা হয়, রাতে খাওয়ার টেবিলে কথা হয়, অফিস থেকেও ফোনে তাদের সঙ্গে কথা বলেন বাবা-মায়েরা। কী কথা? মনোবিদরা বলছেন, তারা খেয়েছে কি না, ঠিক সময়ে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে কি না, স্কুলের পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছে, পরের পরীক্ষার জন্য কতটা মনোযোগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে, এই সব বিষয়ে কথা হয়। বাবা-মায়েরা বলেন, কথা শোনেন না। অনিরুদ্ধের মতে, এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কোথাও আশ্রয়ই পায় না। তাদের কোনও ‘ক্রাইসিস’ থাকলেও জানতে পারেন না বাবা-মায়েরা। বহু ক্ষেত্রেই এমন কোনও বন্ধু তাদের হয় না, যাদের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলতে পারবে। কারণ সকলকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শিখিয়েছেন বাবা-মায়েরা। আগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে তারা একাত্ম হতে পারত। বেশ কিছু বছর হল, সেই সম্পর্কও পড়াশোনা আর নম্বরে সীমাবদ্ধ। ফলে অনেক কিছু থেকেও তারা একা। তাই ‘‘সামান্য ব্যর্থতা, ছোটখাটো না-পাওয়াও তাদের কাছে ‘সুইসাইড লজিক’ তৈরি করে,’’ মনে করছেন তিনি।
হয় জেতো, নয় তো মরো। বছর দুই আগে এক বিজ্ঞাপনের এমন স্লোগান তুমুল বিতর্কে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, বিতর্কটা আসলে ভাবের ঘরে চুরি। কারণ সচেতন ভাবেই এই ছাঁচে ছেলেমেয়েদের তৈরি করা হয়। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ধৈর্য্য কম, অপেক্ষা কম, তাই না-পাওয়ার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। তিনি বলেন, ‘‘যেখান থেকে তারা কিছু পাচ্ছে না, সে বাবা-মা হোক বা প্রেমিক-প্রেমিকা, সেখানেই তারা নিজেকে শেষ করে অপর পক্ষকে চরম শিক্ষা দিয়ে যেতে চাইছে। যাতে চলে গিয়ে অন্তত তারা জিতে যেতে পারে।’’
চলে গিয়েও জিতে যাওয়ার এই মরিয়া স্বভাব তৈরি করার দায় কার? মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের মতে, এই প্রজন্মকে ব্যর্থতার শিক্ষা দিতে না পারাটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। কী ভাবে পেতে হয় তা তারা জানে। না পেলে কী ভাবে কাঁদতে হয় এবং ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তারা শেখেনি। তাই ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে প্রেমিককে ফোন করার ক্ষেত্রে বাবা বাধা দিলেও আত্মহত্যার পথে যায় কিশোরী।
কৈশোর-বয়ঃসন্ধিতে নানা সঙ্কট তৈরি হয়। তার থেকে একাকীত্বে তলিয়ে যায় অনেকে। পরীক্ষার খারাপ ফলের কথা বাড়িতে বললে তারা মার খায়। প্রেমের কথা বললে শুনতে হয়, ‘‘এখনও ও সবের বয়স হয়নি।’’
খবরের কাগজ, টিভি, সিনেমা—সবর্ত্রই এমন ছোটছোট ব্যর্থতার জেরে জীবন শেষ করার অজস্র নজির। চারপাশে কারও এমন ঘটলে চকিতে কিছুটা সতর্ক হন অনেক অভিভাবক। পরবর্তী কয়েকটা দিন সন্তানের মনের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এক দিনেই কি হঠাৎ আশ্রয় হয়ে ওঠা যায়? মনোবিদেরা বলছেন, আশ্রয় হতে গেলে শুধু সাফল্যের মন্ত্র শেখালে হবে না, জীবনের মন্ত্রও শেখাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy