গোপাল তিওয়ারি।
খোদ নেতার বাড়িতেই দুষ্কৃতীর আশ্রয়! ছোঁয়, সাধ্যি কী পুলিশের?
গোপাল তিওয়ারির বেলায় কার্যত এমনটাই ঘটেছিল বলে ইঙ্গিত মিলছে। লালবাজার-সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুরভোটের দিন গিরিশ পার্কের সিংহিবাগানে গুলিচালনা ও তাতে এক এসআই আহত হওয়ার পরেই গোপালকে ধরতে লালবাজারের টিম অভিযান চালায়। কিন্তু গোপাল তখন মধ্য কলকাতার শাসকদলের এক প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে লুকিয়ে, যেখানে ঢুকে তল্লাশি বা গ্রেফতারির অনুমতি মেলেনি। এমনকী গোয়েন্দারা বাড়ির বাইরে ওত পাততে চাইলেও উপরতলা রাজি হয়নি।
ফলে বাড়ির দরজা থেকে পুলিশকে ফিরে আসতে হয়। গোপালও শহর ছেড়ে চম্পট দেয়। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়ানোর পরে গত বৃহস্পতিবার বড়বাজারের ওই ‘ডন’ ধরা পড়েছে। ‘‘বড় মাথার আড়াল না-থাকলে সে দিনই গোপাল আমাদের কব্জায় এসে যেত।’’— আফশোস করছেন গোয়েন্দা-অফিসারদের কেউ কেউ।
বস্তুত তদন্তকারীদের দাবি, শাসকদলের কিছু নেতার মদত নিয়েই যে ভোটের দিন গোপাল-বাহিনী হাঙ্গামা বাধাতে রাস্তায় নেমেছিল, নানা ভাবে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, গোপাল ও তার শাগরেদরা জেরার মুখে সে কথা কবুলও করেছে। নেপথ্যের সেই ‘মদতদাতা’রা অবশ্য ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের নিচুতলার একাংশ কিন্তু বলছে, নিজস্ব তদন্তে ও গোপালদের জেরায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই যায়, এমনকী গ্রেফতারিও অসম্ভব নয়। যদিও লালবাজারের তরফে এমন কোনও উদ্যোগের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এক শীর্ষ গোয়েন্দা-কর্তা তো স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘গোপাল ও তার দলবল কাদের মদতে হাঙ্গামা পাকিয়েছে, সেটা আমাদের তদন্তের বিষয় নয়।’’
এমনটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনেরই পর্যবেক্ষণ, রাজ্যে ইদানীং রাজনৈতিক প্রতিপত্তির কাছে আইনের শাসন বারবার মাথা নোয়াচ্ছে। যেমন আলিপুর থানা ভাঙচুরে স্থানীয় তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দিকে আঙুল উঠলেও চার্জশিটে তার নাম বাদ গিয়েছে। ট্র্যাফিক কনস্টেবলকে প্রকাশ্যে চড় মারার গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি পুলিশ। অতি সম্প্রতি পুলিশ নিগ্রহ ও সরকারি কাজে বাধাদানের ঘটনায় যিনি শিরোনামে, কলকাতার মেয়রের ভাইঝি সেই দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কেও পুলিশ নিরুত্তাপ। ‘‘গোপাল তিওয়ারির পিছনে থাকা প্রভাবশালীরাই বা ব্যতিক্রম হবেন কেন?’’— তির্যক মন্তব্য এক অফিসারের।
লালবাজারের হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা গোপালকে দফায় দফায় জেরা করছেন। তাঁদের বক্তব্য: সরাসরি কারও নাম না-করলেও গোপাল আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার ‘পিছনে’ কারা ছিলেন। বৃহস্পতিবার তেঘরিয়ার হোটেলে গ্রেফতার হয়ে গোপাল খেদ করে বলেছিল, ‘‘যাদের জন্য খাটলাম, তারাই বলির পাঁঠা করল! এখন কেউ নাকি আমাকে চিনতেই পারছে না!’’ গোপালের স্ত্রী কামিনী দাবি করেছেন, শাসকদলের কিছু নেতার সঙ্গে তাঁর স্বামীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, যাঁরা এখন বেগতিক বুঝে ওকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন! গোপালের সঙ্গে দলের একাংশের ‘দহরম-মহরমের’ কথা শোনা গিয়েছে তৃণমূলের অন্দরেও। কী রকম?
দলের একাধিক সূত্রের দাবি, ক’দিন আগেও মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর সঙ্গে গোপালের যথেষ্ট ওঠা-বসা ছিল। জোড়াবাগানের এক অনুষ্ঠানে সঞ্জয়বাবু ও রাজ্যের নারী-সমাজকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজার সঙ্গে একই মঞ্চে হাজির ছিল সে। উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের ছবিটি প্রকাশ্যে আসায় বিতর্কের ঝড় ওঠে, যার জবাবে শশীদেবী তখন বলেন, ‘‘মঞ্চে আমার পিছনে কে কখন উঠছে, জানব কী ভাবে?’’ অন্য দিকে সঞ্জয়বাবুও গোপাল-সংশ্রব বারবার অস্বীকার করে আসছেন। ওই অনুষ্ঠান নিয়ে তাঁর যুক্তি ছিল, ‘‘মঞ্চে আমরা সামনে থাকি। পিছন থেকে কে উঠে পড়ছে, কী ভাবে বুঝব?’’ গোপালের গ্রেফতারি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে শুক্রবার তিনি বলেছেন, ‘‘গোপাল ধরা পড়েছে তো আমার কী?’’ গোপালের নেতা-সঙ্গ নিয়ে রবিবারও সঞ্জয়বাবু মন্তব্য করতে চাননি। ফোন ধরেননি, এসএমএসের উত্তর মেলেনি।
পুলিশ-সূত্রের খবর: ২০০৫-এ বড়বাজারের পোস্তায় এক চায়ের দোকানিকে গুলি করার অপরাধে গোপালের যাবজ্জীবন হয়েছিল। কিন্তু ২০১১-র মে মাসে সে সুপ্রিম কোর্টে শর্তাধীন জামিন পেয়ে বাইরে আসে। রাজ্যে তখন সদ্য পরিবর্তনের জমানা কায়েম হয়েছে। গোপাল মধ্য ও উত্তর কলকাতায় নতুন শাসকদলের কিছু নেতার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, প্রোমোটারি-কারবারকে সামনে রেখে বড়বাজারে তোলাবাজির জাল ছড়ায় গোপাল, যাতে মদত দিতে থাকেন ওই তল্লাটের একাধিক দাপুটে নেতা। মাখামাখিটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, গত পুরভোটে গোপাল নিজের স্ত্রীকে তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী করতে উঠে-পড়ে লাগে। দলীয় সূত্রের দাবি, স্ত্রীর প্রার্থিপদের আর্জি নিয়ে রাজ্যের এক মন্ত্রী-সহ শাসকদলের একাধিক নেতার কাছে দরবার করে সে বিফল হয়।
পাশাপাশি খাস লালবাজারের অন্দরেও ‘বন্ধুত্বের’ হাত বিস্তার করেছিল গোপাল তিওয়ারি। সূত্রের খবর: তার যারপরনাই ‘কাছের লোক’ ছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখার এক অফিসার, যিনি কিনা গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের অব্যবহিত পরে গোপালকে বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। গোপালকে পাকড়াও করতে প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে কড়া নির্দেশ আসায় তিনি প্রকাশ্যে সে চেষ্টায় বিরত হন। যদিও ভিন রাজ্যে পুলিশি অভিযানের খবর গোপালের কাছে আগাম ফাঁস হয়ে যাওয়া আটকানো যায়নি। গোপাল তিওয়ারি ধরার পড়ার পরে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষও স্বীকার করেন, ‘‘আমাদের হানার খবর ও আগে-ভাগে পেয়ে যাচ্ছিল।’’
এত কিছু জানা রয়েছে। তবু নেপথ্যের নায়কেরা কেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে? প্রশ্ন শুনে এক গোয়েন্দা-অফিসার ছুড়ে দিয়েছেন পাল্টা প্রশ্ন— ‘‘কবে কোন ঘটনায় মদতদাতারা ধরা পড়েছে, বলুন তো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy