সেলুলয়েডের পর্দায় তো ছিলই, এ বার ক্রিকেট-বুলেট-বেটিংয়ের যোগাযোগ মিলল বাস্তবেও। আর তা খাস কলকাতায়, গিরিশ পার্ক কাণ্ডের তদন্তের সূত্রে।
ক্রিকেট ও জুয়া, কিংবা জুয়া ও বুলেট অনেক সময়েই বাস্তবে এক বন্ধনীতে চলে এসেছে। কিন্তু ক্রিকেট-জুয়া-বুলেট— এই তিনের যোগাযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বাস্তবে তেমন প্রতিষ্ঠিত না হলেও বলিউডে দেখা গিয়েছিল বছর সাতেক আগে, কুণাল দেশমুখের ‘জন্নত’ ছবিতে, যেখানে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন ইমরান হাসমি।
আর এ বার বাস্তবে, গিরিশ পার্ক কাণ্ডের সৌজন্যে লালবাজারের গোয়েন্দারা জানতে পারলেন ক্রিকেট-বুলেট-জুয়ার যোগ, যেখানে প্রধান চরিত্রের নাম গোপাল তিওয়ারি।
গিরিশ পার্কে গুলিতে সাব-ইন্সপেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলের জখম হওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত গোপালই। পুলিশের দাবি, ঘটনার পর গোপাল কলকাতা থেকে পালিয়ে অন্তত ছ’টি রাজ্যে মাসাধিক কাল আত্মগোপন করে ছিল। আর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে গোপন আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে আন্তঃরাজ্য এক ক্রিকেট বেটিং সিন্ডিকেট। গোপাল নিজেও ওই সিন্ডিকেটেরই অঙ্গ বলে পুলিশ জেনেছে। বৃহস্পতিবার রাতে তেঘরিয়ার হোটেল থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর গোপালকে লালবাজারের হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তা থেকেই এই তথ্য পেয়েছেন অফিসারেরা।
পুলিশের দাবি, আন্তঃরাজ্য ক্রিকেট জুয়াচক্রের তিন বুকি বিভিন্ন রাজ্যে গোপালকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এদের মধ্যে অমিত হায়দরাবাদি অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটকে গোপালকে গা ঢাকা দিতে সাহায্য করেছিল। জুনিয়র ওরফে সুরেন্দ্র বাগরি গোপালকে লুকিয়ে রেখেছিল মহারাষ্ট্রে। লোখান্ডওয়ালায় জুনিয়রের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে বলেও পুলিশ জেনেছে। আবার লেকটাউনের বাসিন্দা বিষ্ণু নামে এক ব্যক্তি এখানে বসেই উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে ক্রিকেট জুয়ার চক্র চালায়। ওই বিষ্ণু দিল্লি, রাজস্থান এবং সম্ভবত পঞ্জাবেও গোপালের জন্য গোপন আস্তানা ঠিক করে দিয়েছিল বলে গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন। তবে গোয়েন্দা সূত্রের খবর, গোপালকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে এখনই ওই বুকিদের ধরা হবে না।
পুলিশ সূত্রের খবর— অমিত, বিষ্ণু, জুনিয়র তিন জনই দেশ জুড়ে চলা ক্রিকেট বেটিং চক্রের গুরুত্বপূর্ণ বুকি। কোটি কোটি টাকা রোজগার তাদের। কিন্তু গোপালও বছর তিনেক ধরে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হয়ে উঠেছে। কী ভাবে? গোয়েন্দা সূত্রের খবর, পোস্তায় খুনের চেষ্টার একটি মামলায় ২০১১-য় জামিনে মুক্ত হওয়ার পরই গোপাল বড়বাজার ও লাগোয়া তল্লাট ঘিরে চলা ক্রিকেট জুয়ার সিন্ডিকেট থেকে তোলা আদায় শুরু করে। ২০০৫ সালে পোস্তার সেই ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে যাওয়ার আগেও সে এই কাজ করত। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় কাজে নেমে গোপাল বোঝে, সিন্ডিকেট চালিয়ে আন্তঃরাজ্য চক্রে নিজেকে সামিল করতে পারলে রোজগার বহু গুণ বেশি। তাই নিজেই বেটিং সিন্ডিকেট শুরু করে গোপাল।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘তোলা আদায়, প্রোমোটিংয়ের মাধ্যমে তার আয়কে ইদানীং ছাপিয়ে গিয়েছিল ক্রিকেট বেটিং থেকে গোপালের রোজগার। প্রতি আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার রোজগার ছিল এক লক্ষ টাকা। ভারত খেললে কিংবা কোনও টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনাল বা ফাইনাল হলে আসত আরও বেশি টাকা।’’ তবে তদন্তকারীরা জেনেছেন, এ বার আইপিএল শুরু হওয়ার ১২ দিনের মধ্যে গোপালকে পালাতে হয় বলে রোজগারে কোপ পড়ে। এই জুয়া-চক্রের সূত্রেই তার যোগাযোগ বিষ্ণু, জুনিয়র, অমিত হায়দরাবাদির সঙ্গে। কলকাতা শহরে বসে চালানো নিজের বেটিং চক্র থেকে গোপাল ওদের অনেক লাভ দিয়েছে। তাই ওই বুকিরাও গোপালের পাশে থেকেছে।
গোপালকে বৃহস্পতিবার যে হোটেল থেকে ধরা হয়েছে, তার কাছেই বুকি বিষ্ণুর পানশালা। গোয়েন্দারা জানান, গোপালের বেটিং সিন্ডিকেট দেখাশোনা করে রোশন নামে এক যুবক। বিজয় শর্মা নামে এক জন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তাকে মারধর করে। মাস খানেক পর বদলা নিতে গোপাল এক বন্দুকবাজকে পাঠায়। কিন্তু বিজয় শর্মা ভেবে অন্য এক জনকে গুলি করে সেই দুষ্কৃতী এবং তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ওই পরিকল্পনায় বিষ্ণু গোপালকে সাহায্য করেছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ।
কিন্তু গোপাল ও বিষ্ণুকে গ্রেফতার করার মতো প্রমাণ তখন মেলেনি। তবে ওই ঘটনার পর লালবাজারে গোপালকে ডেকে এনে সতর্ক করে দেন গোয়েন্দারা। তখন তাঁরা জানতেন না, কয়েক মাসের মধ্যেই গোপালকে গ্রেফতার করার জন্য তাঁদের কালঘাম ছোটাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy