Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

আলোর দাপটে বিভ্রান্ত পাখিরা

সল্টলেকের বাসিন্দারাও টের পাচ্ছেন পাখিদের যন্ত্রণা। আগে ভোরবেলা হলে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙত অনেকের।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৪০
Share: Save:

গাছের ডালে, কোটরে দিব্যি ছিল ওরা। সন্ধে হলেই বাসায় সেঁধিয়ে যেত। ভোরের আলো ফুটলে ফের বেরিয়ে চেঁচামেচি জুড়ত। কিন্তু গত ক’দিনে বদলে গিয়েছে ওদের জীবন। সল্টলেকের পাখিদের জীবনে এখন অফুরন্ত আলোর যন্ত্রণা!

সল্টলেকের বাসিন্দারাও টের পাচ্ছেন পাখিদের যন্ত্রণা। আগে ভোরবেলা হলে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙত অনেকের। এখন মাঝ রাতেও ওদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, আলোর আতিশয্যে এমনিতেই শহরের পাখিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার উপরে সল্টলেকে যুব বিশ্বকাপের জন্য এত আলো দেওয়া হয়েছে যে পাখিদের দিন রাতের হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশকর্মীদের একাংশের দাবি, এই আলোর দাপটের প্রভাব পড়বে পাখিদের জীবনচক্রে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের প্রজনন। ফলে জীববৈচিত্র এবং পরিবেশেরও ক্ষতি হবে। পক্ষী বিশারদদের মতে, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানাতে না পেরে বহু পাখিই সল্টলেকের মতো এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারে।

আলোর দাপটে পাখিদের স্বভাব কেমন ভাবে বদলে যায় তা টের পেয়েছেন শহরতলির অনেক বাসিন্দাই। শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় পুরনো বাড়ি, গাছপালা এখনও আছে। ফলে পাখির সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে বেশি। গত কয়েক বছরে যে ভাবে একের পর এক উঁচু বাতিস্তম্ভ বসানো হয়েছে. তাতে মাঝ রাতেও রাস্তাঘাট এলাকা দিনের মতো লাগে। এবং গভীর রাতেও কাকের ডাক, শালিক, ছাতারে পাখির কিচমিচ কানে আসে। এমনটা কিন্তু আগে ছিল না। শুধু আমজনতা নয়, বেহালার একটি পার্কে কাকেদের হাহাকার টের পেয়েছিলেন পরিবেশমন্ত্রী তথা মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর নির্দেশে আলো নিভতেই শান্তি পেয়েছে ওই কাকের দল।

ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা এবং পক্ষী বিশারদ সুজিত চক্রবর্তীর মতে, প্রত্যেক প্রাণীর শরীরে একটি নির্দিষ্ট ঘড়ি কাজ করে যাকে ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ বলা হয়। সেই ঘড়ির ছন্দ ধরেই প্রাণীর দৈনন্দিন জীবন চলে। এই অতিরিক্ত আলোর ফলে পাখিদের সেই ঘড়ির ছন্দ নষ্ট হচ্ছে। ফলে ওদের স্বভাব বদলাতে হচ্ছে। সুজিতবাবুর নিজেও সল্টলেকের বাসিন্দা। ফলে পাখিদের এই বদল তাঁর চোখে অনেক বেশি করে ধরা পড়ছে। তিনি বলছেন, ‘‘রাতের বেলা পাখিরা বিশ্রাম নেয়। সেটা নষ্ট হলে পরের দিন সকালেও ওরা স্বাভাবিক থাকতে পারবে না।’’ তিনি আরও জানান, পেঁচার মতো নিশাচর পাখিরা রাতের আঁধারেই খাবার খুঁজতে বেরোয়। কিন্তু আলোর দাপটে ওরা দিশেহারা হচ্ছে। খাবার খুঁজতেও পারছে না। তবে এই আলোর দাপটে কারও কারও আবার পোয়াবারো হয়েছে। সুজিতবাবুর চোখে ধরা পড়েছে, ফিঙের মতো পোকা-পতঙ্গভুক কিছু পাখি আঁধারে টুক করে বেরিয়ে আসছে। তার পর আলোর সামনে জড়ো হওয়া পোকা-পতঙ্গ মুখে পুরেই আবার গাছের কোটরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ পাখিই এই দলে পড়ে না।

বস্তুত আলোর এই বিপদের কথা রবীন্দ্র সরোবরের মামলাতেও উঠেছিল। সেখানে পরিবেশবিদদের অভিমত ছিল, আলোগুলি যাতে গাছের ক্ষতি করতে না পারে তেমন ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিরোধী যুক্তিও রয়েছে। তাঁরা বলছেন, যুব বিশ্বকাপ বা পুজোর মতো অনুষ্ঠানে কি আলো দিয়ে সাজানো হবে না? উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেও আলো বাড়বে। তা ছাড়া, যুব বিশ্বকাপ মিটলে আলো কমবে। ফলে পাখিদের চিরস্থায়ী সমস্যা হবে না।

পরিবেশকর্মীদের অনেকে এই যুক্তি মেনে নিয়ে বলছেন, সে ক্ষেত্রে গাছ এবং পাখিদের যাতে ক্ষতি না হয় সে কথা মাথায় রেখেই আলো লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আলোর উপরে শেড ব্যবহার করা যেতে পারে। রাজ্য সরকারের এক পরিবেশবিদ বলছেন, পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই সল্টলেক, রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় এত গাছ লাগানো হয়েছিল। সেই গাছের জন্যই এত পাখি থাকে। সেই পাখিদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হলে ওরা ঠাঁই বদলাবে। তাতে কিন্তু সল্টলেকের পরিবেশটাও বদলে যাবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE