‘‘আরেকটা নতুন রেস্তোরাঁ! আমাদের পাড়াটা কেমন দোকান-পাড়া হয়ে গেল, না দিদি?’’ সত্যি, হিন্দুস্থান পার্ক, কেয়াতলা, পূর্ণ দাসে রোজই দেখি খাওয়ার দোকান খুলছে! ধাবা, চিনে, বাঙালিয়ানা, কফি, পেস্ট্রি— কারা এত খাচ্ছে বাইরে? নীলু বলে, ‘‘শুধু খানাই তো না দিদি, আর কাপড়চোপড়ের দোকান? হিন্দুস্থান পার্কেই দেখুন, ফ্যাব ইন্ডিয়া, খদ্দর, বাইলুম, বুনকারী, ভূমিসুতা, দেবশ্রী— আরও কত যে দোকান হয়েছে, সব মনেও আসছে না ছাই। আমাদের সেই ছোটবেলার হিন্দুস্থান পার্ক আর থাকল না দিদি, পুরো হই চই বাজারে- পাড়া হয়ে গেল, কোনও মানসম্মান রইল না পাড়াটার—’’
নীলু আমার মেয়েদের বয়সি, পাড়ার ক্যাম্পের মেয়ে, তার যদি হিন্দুস্থান পার্কের চরিত্রহানির জন্য এত কষ্ট হয়, তাহলে আমার কেমন লাগবে? আমি এই ৭২ নম্বর বাড়িতেই জন্মেছি, ৭৭ বছর ধরে এই ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির বাসিন্দে, এই পাড়ার আদিবাসীদের এক জন। সত্যিই এমন ‘দোকান-পাড়া’ ছিল না আমার পাড়াটি। শিষ্টজনের সংসারযাপনের সম্ভ্রান্ত পল্লি ছিল, ভিড়ে ভর্তি ‘বাজারে-পাড়া’ ছিল না। এখন সারাদিন রাস্তা ভরে ফিল্মের শ্যুটিং-এর হই হুল্লোড় লেগেই আছে। যে দিন সত্যি আগুন লেগেছিল, জগদীশ পুড়ে গেল, আমরা ভেবেছি বুঝি শ্যুটিং হচ্ছে! ফাঁকা, শান্ত, ঘরোয়া পাড়া ছিল, লেকের হাওয়া বাতাস বইত দিনে রাতে, বাড়িগুলি দোতলা, বড় জোর তেতলা। বেশির ভাগ বাড়িতেই বাগান। আমার গাছে চড়ার বিদ্যে তো এই হিন্দুস্থান পার্কেই রপ্ত। আমাদের রাস্তাটিও ফাঁকা ছিল, বিকেলবেলায় পাড়ার ছেলেমেয়ে সবাই মিলে রাস্তায় ছুটোছুটি করে, আর এ বাড়ি- ও বাড়ি- উঠোনে- বাগানে ঢুকে- বেরিয়ে কত কী খেলতুম, চোর চোর, চু কিৎ কিৎ, আই স্পাই (আমি ভাবতুম খেলাটার নাম বুঝি ‘আইস পাই’, আইসক্রিমের বোন)। ছেলেরা ফুটপাথে গোড়ালি দিয়ে গর্ত করে গুলি খেলত, ঊর্ধ্বমুখে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে ছুটত পিচের রাস্তা দিয়ে, গাড়ির অত্যাচার ছিল না। তাদের সাবধান করে দেওয়ার লোকেরও অভাব ছিল না। বাড়ির সামনে বড়রাও বেরিয়ে একটু বসতেন বিকেলবেলায়, গপ্পোগাছা করতেন, ছেলেমেয়ের ওপরে নজরও রাখতেন। রাস্তার বাতি জ্বলে উঠলে, রাস্তার লোকেও বকুনি দিয়ে যেত, ‘বাড়ি যাও’! এক-একটা জমি খালি ছিল সেখানে পাঁচিলে ঘুঁটে দেওয়া হত, আর মাঠে ফুটবল খেলত ছেলেরা। রাস্তায় ক্রিকেট। জ্যোতি বসুর দাদার বাগানে প্রচুর আম ফলত (সেই আম আমরা চুরি করতুম, এখনও সোল্লাসে কুড়োয় পাড়ার বাচ্চারা), যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘ইলাবাস’ বাড়িতেও অনেক রকমের ফলের গাছ ছিল। এরই মধ্যে প্রাণ ভরে খেলাধুলো করে আমরা বেড়ে উঠেছি। এ বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নি, ও বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোর নাড়ু, তাদের উঠোনে হরির লুঠের বাতাসা কুড়নোর কম্পিটিশন। দোলের সময়ে পিচকিরি নিয়ে হুল্লোড়। ১৫ অগস্টে রাত থাকতে গান গেয়ে প্রভাতফেরি। সরস্বতী পুজোয় জলসার জন্য রিহার্সালটাই অধিক জরুরি! পাড়াসুদ্ধু রাস্তায় বসে হিম মাথায় নিয়ে রাত্তির বেলা সিনেমা দেখা। এই আমাদের জমজমাট আহ্লাদী পাড়া ছিল।
হ্যাঁ এটাই। সেটা এই পাড়াটাই। শুনলে বিশ্বাস হচ্ছে না তো? এই দু’ধারে গাড়ির জঙ্গলে ভরা সদা গতিব্যস্ত রাস্তাটাই। বহু পরিবারের বসতি নিয়ে অহঙ্কারে আকাশ-ঢাকা, অপরিচয়ে ঊর্ধ্বমুখ সৌধগুলির জায়গায় এক দিন ঘরোয়া বাড়ি ছিল। এখন এ পাড়ায় দোতলা পুরনো বাড়ি বলতে ওই জরাজীর্ণ, বিবর্ণ, কুরূপ, ঝোপজঙ্গলে ভরে যাওয়া বল-সাহেবের পোড়ো ভিটেটুকু, একদা যেখানে দুর্গাঠাকুরের প্রতিমা গড়েছেন কুমোর দাদু এসে। আমাদের বাড়িতে বিদেশের বন্ধুরা এলে, মুগ্ধ হয়ে ওই সবুজ বাগান ঘেরা, ধবধবে সাদা দোতলা বাড়ির বারান্দার কলোনিয়াল স্থাপত্যের ফটো তুলে নিয়ে যেতেন। এখন? স্খলিত পতিত বাসনার ভার! আইনি ফাঁদে বাঁধা, প্রোমোটরদের ধাঁধা।
আর ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’-র ওদিকের সেই গ্রে রঙের, ফুলন্ত লতা-দোলানো, মেট্রো প্যাটার্নের সেই স্টাইলিশ বাড়িটা? আমার অত আদরভরা মামার বাড়ি? উধাও।
আমার মনে হয় বলসাহেবের বাড়িটাই আমাদের পাড়ার বর্তমান আত্মার ছবি। যে দিন থেকে বাইরে এই পাড়ার দিক নির্দেশক হল ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’ বিপণি, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুধর্মা’- বাড়ির পরিচয়ের বদলে সে দিন থেকেই আমাদের আত্মপরিচয়ের রদবদল শুরু। এমনকী জ্যোতি বসুর বাড়িও এখন কেউ চেনে না, খোঁজে, ‘ফিফটিফাইভ’, গেস্ট হাউস? আগে ‘ভালো-বাসা’ বাড়ি ছিল পথ নির্দেশের চিহ্ন, এখন আমার কাছে লোকে জানতে চায় আমার বাড়ির কাছাকাছি দিক-চিহ্নটি কী? আমি সবিনয়ে জানাই চিনে রেস্তোরাঁর হদিশ। নরেন্দ্র-রাধারানীর ‘ভালো-বাসা’, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘ইলাবাস’, সুনীতিবাবুর ‘সুধর্মা’ এখনও সশরীরে অবস্থিত, বিশেষ প্ল্যাকার্ড নিয়েই, ‘হেরিটেজ’ বিল্ডিং,— কিন্তু সে সব কে চিনছে! কোনও দিন ‘ভালো-বাসা’ হয়ে যাবে, ‘ওই বুনকারীর বাড়িটা’।
অভিজাত গৃহস্থের বাসভূমি থেকে বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠছে আমার পাড়া। মিষ্টির দোকান উঠে যাচ্ছে, আর কেক পেস্ট্রির দোকান খুলছে পাড়ায়। ইস, এতগুলি ফ্যশানি দোকান, কিন্তু কেউ কখনও হিন্দুস্থান পার্কে একখানাও বইয়ের দোকান খোলেনি কেন গো?
মা জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির রাঙ্গামাসু-র সঙ্গে শিক ধরে দাঁড়িয়ে দুপুরবেলায় গল্প করতেন। মাসুর নাতনি রত্না আর আমিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতুম ছাদে বেরিয়ে, রোদ বিষ্টি গায়ে লাগত না। দুই বাড়িতে চার পরিবার, ভাড়াটেরা তখন আত্মীয় সমান, রান্নাঘরে ব্যঞ্জনের আদানপ্রদান চলত। অসুখে সেবা করতে যে কেউ চলে আসতেন স্বেচ্ছায়। একটা ফোনে সারা পাড়ার কাজ চলত।
আর লেক ছিল আমাদের পাড়ার আত্মার শান্তি। ছেলে বুড়ো স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে লেকে হাওয়া খেতে যেতুম, ভোর রাত থেকে সেই মাঝরাত অবধি, নির্ভাবনায়, এখন সে সব রূপকথার মতো অলীক শোনাবে। বিবেকানন্দ পার্কের সবুজ এখন কয়েকটি নির্দিষ্ট খেলার ক্লাবের মধ্যে বিভক্ত। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের বাইরে খেলতে যাওয়ার মতো জায়গা নেই। আর পার্কের বাকিটা এখন জলকল পাকা রাস্তা সমেত স্বয়ংসম্পূর্ণ কলোনি। কিন্তু কলোনির বাইরেটা এত বেশি অযত্নে শ্রীহীন, অপরিচ্ছন্ন যে পার্কের পাশ দিয়ে যেতে লজ্জা করে। পাঁচিলটি রমণীয় করে তোলা যায় না?
যদিও হিন্দুস্থান পার্ক মূলত ছিল বাঙালি পল্লি, তারই মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন কয়েক ঘর শিখ প্রতিবেশী, মাঝে মাঝে তাঁদের ভজন কীর্তন হত, আমাদের ভাগ্যে দারুণ স্বাদু হালুয়া জিলিপি ইত্যাদি জুটত। ‘ভালো-বাসা’র সঙ্গে মিলিয়ে ‘অভিমান’ নাম রেখে পাড়ার বহুতল ফ্ল্যাট বাড়িটি তৈরি হয়েছিল আমি বড় হওয়ার পরে। ‘অভিমানে’ এলেন কিছু দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার। তাঁদের বাড়িতে রান্না হত না, কী মজা, রোজ পাড়ার সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব থেকে টিফিন কেরিয়ারে ভরে ইডলি-ধোসা আসত! ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার চরিত্র বদল হতে শুরু করেছে, ফ্ল্যাটবাড়ির কালচার আর পৈতৃক বসত বাটিকার কালচার তো এক নয়? হিন্দুস্থান পার্কে এখন অনেক বেশি লোক, কেউ কাউকে চিনি না।
বাড়ি বাড়ি জলবিশুদ্ধকরণ যন্তর বসে গিয়ে, দু’বেলা ঘড়া কাঁখে কল থেকে খাবার জল আনার ধারাটি শুকিয়ে এসেছে, যা একদা পুকুরঘাটে জল আনতে যাওয়ার চেয়ে বিন্দুমাত্র কম উত্তেজক ছিল না। তখন টিউবওয়েলটা বাড়ির সামনেই থাকায় ঘরে বসেই শুনতে পেতুম কে ঘোরতর অসুস্থ, কার বউ কার সঙ্গে পালিয়েছে, কার বাড়িতে নিত্যি কাবুলিওয়ালা আসছে। রিকশওয়ালারা আর ভারীরা রোজ এই কলেই স্নান সারত। এই প্রখর রোদ্দুরে সেই শীতল পানীয় জলের টিউবওয়েলটির অভাব ঘরে বসেও বিশেষ ভাবে অনুভব করি।
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy