রাজীব দাস। ইনসেটে কালিকাপ্রসাদ।— নিজস্ব চিত্র।
৭ মার্চ। আরও একটা ৭ মার্চ চলে এল। কিন্তু ২০১৭-র ৭ মার্চের পর থেকে এই তারিখটা আমি মনে রাখতে চাই না। আমরা মনে রাখতে চাই না। ‘দোহার’ মনে রাখতে চায় না। ওই দিনটাতেই চলে গিয়েছিল আমাদের মনের মানুষ কালিকাপ্রসাদ। আমার কালিকাদা।
বরং আমি বা আমরা অর্থাত্ ‘দোহার’-এর সকলেই মনে রাখতে চাই ১১ সেপ্টেম্বরকে। কারণ ওই দিন আমাদের প্রাণের মানুষের জন্মদিন। ওটাই আমাদের উত্সবের দিন। গানের দিন। প্রাণের দিন। আনন্দের দিন।
কালিকাদার যা ছিল সেটা ওর জন্মগত। ও তো আর কারও হবে না। কিন্তু তাই বলে কি, কাজ থেমে থাকবে? এই যে এত স্বপ্ন দেখত মানুষটা, আমাদের স্বপ্ন দেখাত— সে সবের কি হবে? গত এক বছরে ‘দোহার’-এর কাছে সেটাই একটা বড় বিষয় ছিল।‘দোহার’ অনেক নতুন কাজ করছে। প্রথমবার কর্মশালার আয়োজন করছে। এ সব তো ওরই দেখানো পথ।
‘দোহার’-এর পথ চলা শুরু কালিকাদা আর আমার হাত ধরেই। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছি, ক্লাসিক্যাল শিখেছি। কিন্তু কালিকাদার সংস্পর্শে এসে লোকগানের যে সমুদ্রে পড়লাম তা অগাধ। আজও সেই সাধনাই করে চলেছি। আমাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্পেস ছিল। আমরা একে অপরকে সেটা দিতাম। ও দক্ষিণ কলকাতায় থাকত। আমি উত্তরে। অনেকবার ওর বাড়ির পাশে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু সচেতন ভাবেই যাইনি। তবে এ ক’বছরে গান মানেই আমি আর কালিকাদা একসঙ্গে…।
আরও পড়ুন, অনুষ্কার প্রিয় বাংলা শব্দ? ‘পরী’তে জেনে ফেলেছেন পরমব্রত
‘দোহার’-এর সংসারের অন্দর সামলাতাম আমি। আর বাইরেটা কালিকাদা। প্রথম থেকেই এটা হয়েছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সঙ্গে কথোপকথন হোক বা মিডিয়ায় কোনও বক্তব্য— সবেতেই কালিকাদা। আর ওর মতো সূত্রধর তো আর কেউ হতে পারবে না। এমনও হয়েছে, দর্শক অনুরোধ করেছেন, আজ শুধু কথা শুনতে চাই, গান কম। সেটাই হয়েছে। এত সহজ ভাষায় লোকগানকে গেঁথে দিত মানুষের মনে…। অসম্ভব দক্ষ ছিল এ বিষয়ে।
আমার মনে আছে, পুরুলিয়ার সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আয়োজনে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সম্ভবত বিষয় ছিল, বঙ্গসমাজ ও সাহিত্য: প্রতিবেশীর অবস্থান। তো যাওয়ার আগে, আমি বলেছিলাম, ‘‘কিছুই তো প্রস্তুতি নেওয়া হল না।’’ কালিকাদা বলেছিল, ‘‘চলো না, যা হবে দেখা যাবে।’’ তার পর ওখানে গিয়ে দেখা গেল, আমরা আমাদের চেনা গানই গাইলাম। কিন্তু যে ভাবে একটা গানের থেকে অন্য গানে যাওয়ার পথ বেঁধে দিল কালিকাদা, যে ভাবে গানের ইতিহাস সহজ কথায় বুঝিয়ে দিল, তাতেই সেমিনারের বিষয় বলা হয়ে গেল। এমনটাই ছিল আমাদের কালিকাদা।
ও চলে যাওয়ার পর আমাদের দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল। তখন অনেকে অনেক কথা বলেছেন। সে সব আর মনে করতে চাই না। আমি সে দিন দলের সকলকে আমার বাড়িতে ডেকেছিলাম। প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী চাই আমরা? থেমে গেলে তো চলবে না। পিছিয়ে পড়ার তো কোনও উপায় নেই। কারণ কালিকাদা যে স্বপ্নটা দেখত, যে স্বপ্নটা আমাদের সকলকে দেখিয়েছে তা তো এগিয়ে নিয়ে যাব আমরাই।
আরও পড়ুন, প্রযোজক অনুষ্কাকে নিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা বাঙালি পরিচালকের
কালিকাদা যে ডুবকিটা বাজাত, প্রত্যেক অনুষ্ঠানে আমরা মঞ্চে সেটা রাখি। আমরা বিশ্বাস করি প্রত্যেক মুহূর্তে কালিকাদা আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। দর্শকদেরও সেটাই বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করি। আমরা বলি, আপনারা মঞ্চে সাত জনকে দেখতে পাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করুন, কালিকাদাকেও দেখতে পাবেন। বাড়িতে কালিকাদার কোনও ছবি রাখি না আমরা। মালা দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। কারণ মানুষটা তো আমাদের সঙ্গেই আছে।
তবে একটা কথা কী জানেন, বড্ড রাগ হয়। হ্যাঁ, কালিকাদা তোমাকেই বলছি। তোমার ওপর রাগ হয়। আমাদের ওপর সব গুরুদায়িত্ব দিয়ে পরম আনন্দে আছ, এটা ঠিক না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy