বেসরকারি ক্লিনিকাল ল্যাবরেটরির ঠিকানায় আস্ত খাটাল। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে ডাক্তারের ভুয়ো নাম। পরীক্ষার কিট মেয়াদ উত্তীর্ণ— এমন ল্যাবরেটরির উপর নির্ভর করেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররাই বাইরের ল্যাবের সঙ্গে রোগীদের যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রায় মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত এই নেটওয়ার্ক। স্বাস্থ্য দফতর কিন্তু বিষয়টি হাসপাতালের উপরে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত।
গত বুধবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে আইসিসিইউ ৩-এ ভর্তি হন বরাহনগরের বাসিন্দা বছর পঁয়ষট্টির রেবা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর একটি রক্ত পরীক্ষা জরুরি ভিত্তিতে বাইরে থেকে করিয়ে আনতে বলেছিলেন ডাক্তারেরা। রোগিণীর পরিবারের দাবি, কার্ডিওলজি বিভাগের জুনিয়ার ডাক্তারদের একাংশের পরামর্শেই শিয়ালদহ এলাকার একটি প্যাথোলজিকাল ক্লিনিকে তাঁরা রক্তের নমুনা দিয়েছিলেন। শিয়ালদহের ওই ক্লিনিক থেকে নমুনাটি পরীক্ষার জন্য গিয়েছিল সুকান্তনগরের একটি ল্যাবে। তারাই রিপোর্ট তৈরি করে পাঠায়।
রেবাদেবীর পুত্র অংশুমান চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, তিনি রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে পরীক্ষার কিটগুলি দেখতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করেন, এইচআইভি কিটটি মেয়াদ-উত্তীর্ণ। সেই কেঁচো খুঁড়তে গিয়েই এখন বেরিয়ে পড়ছে একের পর এক কেউটে!
রেবাদেবীর নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন শিয়ালদহের গোমস লেনের ক্লিনিকের কুরিয়ার বয় সত্যজিৎ সাহা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ওই ক্লিনিকটি শুধু নমুনাই সংগ্রহ করে। পরীক্ষা করে না। পরীক্ষার জন্য ওই সব নমুনা তারা পাঠায় শহরের বিভিন্ন ল্যাবে। ওই সব ল্যাবের কুরিয়ার বয়-রা এসে নমুনা নিয়ে যান। ওই ল্যাবগুলিরই একটি হল, সুকান্তনগরের ‘পয়েন্ট ল্যাব’। সেখানেই রেবাদেবীর রক্তের নমুনা গিয়েছিল। ওই ল্যাবরেটরির নামেই রিপোর্ট তৈরি হয়। অথচ সুকান্তনগরে ল্যাবরেটরিটির ঠিকানায় গিয়ে দেখা গিয়েছে, ‘এন-৩৮৭’ নম্বরে বাস্তবে কোনও ল্যাবরেটরি-ই নেই! রয়েছে একতলা বাড়ির ভিতর একটি খাটাল ও কিছু গরু!
রহস্য এখানেই শেষ নয়। ওই রক্তের রিপোর্টের নীচে মাইক্রোবায়োলজিস্ট-এর সইয়ের জায়গায় সৌম্যব্রত নাগ নামে একজন চিকিৎসকের নাম লেখা রয়েছে। পাশে লেখা ‘এমবিবিএস, এমডি। কনসালটেন্ট মাইক্রোবায়োলজিস্ট, আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।’ কিন্তু আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজির প্রধান মিতালি চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমার বিভাগে ওই নামে কোনও মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই!’’
সৌম্যব্রত নাগ তবে কে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই নামে এক চিকিৎসক শহরের একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে কর্মরত। সৌম্যব্রতবাবু জানাচ্ছেন, তিনি কোনও দিনই আরজিকরে কাজ করেননি। সুকান্তনগরের ওই ল্যাবের সঙ্গেও তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর নামে যে সেখানে দিনের পর দিন রক্তের রিপোর্ট লেখা হচ্ছে, এ কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ছেন সৌম্যব্রতবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘আমার নামটা কেউ আমাকে না জানিয়ে ব্যবহার করেছে!’’
বিষয়টা তবে কী দাঁড়াল? সুকান্তনগরের ল্যাবরেটরি ‘ভুয়ো’! রিপোর্ট যিনি তৈরি করেছেন সেই মাইক্রোবায়োলজিস্টও ‘ভুয়ো’! সংস্থার যে দু’টি ফোন নম্বর রিপোর্টে ছাপা রয়েছে, সেগুলিও অকেজো।
শিয়ালদহের ওই কুরিয়ার বয় দাবি করছেন, ‘‘সুকান্তনগরের ল্যাব থেকে প্রবীর কুণ্ডু নামে এক জন কুরিয়ার বয় এসে আমাদের থেকে নমুনা নিয়ে যেতেন। আমরা কখনও সুকান্তনগরের ল্যাবে যাইনি। ওরা অনলাইনে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিত আর টেস্টিং কিটগুলো দিয়ে যেত।’’ ঘটনাচক্রে এই প্রবীর কুণ্ডুর যে মোবাইল নম্বরে শিয়ালদহের কুরিয়ার বয়-রা যোগাযোগ করতেন, সেই নম্বরটিই ল্যাবের ফোন নম্বর হিসেবে রক্তের রিপোর্টে রয়েছে। সেই নম্বরটি যেহেতু অকেজো, ফলে যোগাযোগ করা যায়নি প্রবীরবাবুর সঙ্গে।
কিন্তু শিয়ালদহের ক্লিনিকটির কর্ণধার কিছু জানতেন না এত দিন? তাঁর কাছ থেকে রক্তের নমুনা কোথায় যাচ্ছে, সেগুলো আদৌ নির্ভরযোগ্য ল্যাব কি না, তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেননি? সুকান্তনগরের এই ল্যাবের মতো আরও ভুয়ো ল্যাব তাঁদের তালিকায় রয়েছে কি না, তিনি জানেন কি? ক্লিনিকের কর্ণধার শ্যামল বাগ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি একাধিকবার ফোন তুলে পুরো বিষয়টি শুনে তার পর ‘আমি শ্যামল বাগ নই’ বলে ফোন কেটে দেন। অথচ কুরিয়ার বয় সত্যজিৎ সাহার অভিযোগ, নীলরতন কর্তৃপক্ষ, রোগীর পরিবার এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার দায়ে ক্লিনিক থেকে তাঁর চাকরি গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েও রোগীর ভাগ্য বেসরকারি ‘ভুয়ো’ ল্যাবরেটরির হাতে চলে যায় কী করে? নীলরতনের নিজস্ব সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি, প্যাথোলজি ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ কি রক্ত পরীক্ষা করতে পারে না? নীলরতনের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান কাজল গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘কিছু-কিছু পরীক্ষা হাসপাতালে হয় না, তা ছাড়া রুটিন পরীক্ষাতেও একটু সময় লাগে। তাই কয়েকটি ইমার্জেন্সি কেস-এ বাইরের ল্যাবরেটরি থেকে রক্ত পরীক্ষা করে আনতে বলা হয়।’’
রেবা চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে অংশুমানবাবুর কিন্তু অভিযোগ, তাঁরা শিয়ালদহের গোমস লেনের ল্যাবরেটরি চিনতেন না। গত মঙ্গলবার তাঁর মা-কে কার্ডিওলজিতে চিকিৎসক মনোরঞ্জন মণ্ডলের ইউনিটে ভর্তি করার পর কয়েক জন জুনিয়ার ডাক্তারই তাঁকে ওই ল্যাবরেটরির দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেন। অংশুমানবাবুর কথায়, ‘‘ওয়ার্ডের মধ্যেই ওই কুরিয়ার বয় ঘুরঘুর করছিলেন। তাঁকে জুনিয়ার ডাক্তাররাই ডেকে আনেন, আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমাকে বলেন, ওঁদের সংস্থা থেকে যেন মায়ের রক্ত পরীক্ষা করাই।’’ ওই ডাক্তারদের নাম অবশ্য অংশুমানবাবু বলতে পারেননি। তবে শিয়ালদহ ল্যাবরেটরির ওই কুরিয়ার বয়-এরও দাবি, ‘‘আমরা শুধু নীলরতন নয়, সব সরকারি হাসপাতালে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াই। ডাক্তারবাবুরা আমাদের চেনেন। তাঁরাই দিনে ২০-৩০টি রোগীর রক্তের নমুনা আমাদের দেন, বদলে তাঁরা কমিশন পান। অনেক বিভাগীয় প্রধান, সুপাররাও কমিশনের ভাগ পান।’’
অথচ কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান কাজল গঙ্গোপাধ্যায় স্পষ্ট বলছেন, ‘‘বাইরে পরীক্ষার জন্য গেলেও আমাদের ডাক্তারেরাই রোগীর রক্ত সিরিঞ্জে টেনে দেন। কিন্তু কখনওই কোনও ল্যাবরেটরির নাম তাঁদের বলার কথা নয়। তাঁরা তা বলেন না।’’
কিন্তু কুরিয়ার বয়ের দাবি এবং অংশুমানবাবুর অভিজ্ঞতা তা বলছে না। মায়ের রিপোর্টে মেয়াদ উত্তীর্ণ কিটের কথা তিনি নীলরতনের চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন। অংশুমানবাবুর কথায়, ‘‘জুনিয়ার ডাক্তারেরা আমাকে বলেন, তাঁরা ওই ল্যাবরেটরিকে ব্ল্যাক লিস্ট করবেন। অনুরোধ করেন, আমি যেন বিষয়টি পাঁচ কান না-করি।’’ রেবাদেবীর যাঁর ইউনিটে ভর্তি ছিলেন, সেই চিকিৎসক মনোরঞ্জনবাবু কী বলছেন? তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘‘যা বলার বিভাগীয় প্রধানকে বলেছি।’’
বিষয়টি সামনে আসার পর এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী করবেন? নীলরতনের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘চিকিৎসকেরা যদি নির্দিষ্ট ল্যাবের নাম বলে দেন এবং পরে সেই ল্যাবের অস্তিত্বই না পাওয়া যায় সেটা তো মারাত্মক। আমি তদন্ত করে দেখতে বলেছি।’’
কিন্তু কুরিয়ার বয়ের দাবি অনুযায়ী, এমন চক্র তো শুধু নীলরতন নয়, অন্যান্য হাসপাতালেও রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সে ব্যাপারে কিছু করবে না? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এখনই কিছু ভাবা হয়নি। এনআরএস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বাইরের ল্যাবের নাম রেফার না করতে বারবার বলা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে, সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।’’
কিন্তু ‘শুভবুদ্ধি’র অভাবে যে রোগীরা ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন, তার কী হবে? অংশুমানবাবু মাকে এনআরএস থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছেন। শহরের একটি নামী ল্যাব থেকে মায়ের ফের রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন। সেই রিপোর্ট ‘পয়েন্ট ল্যাবে’র রিপোর্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অংশুমানবাবু শিউরে উঠে বলছেন, ‘‘ওই ভুয়ো রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি মায়ের চিকিৎসা হতো, কী হতো তা হলে? আরও কত জন এই ভাবে ভুয়ো রিপোর্টের শিকার হয়েছেন অতীতে, তা-ই বা কে জানে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy