মধুবনী চিত্রকলায় সাজছে কাঁকুড়গাছির এক পুজোমণ্ডপ। ছবি: সুমন বল্লভ
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক। থিম পুজো সবে জাঁকিয়ে বসছে শহরে। মণ্ডপ সাজাতে শিল্পীরা বেরিয়ে পড়েছিলেন নানা প্রান্তে। কেউ দেখালেন এ রাজ্যেরই বিভিন্ন হস্তশিল্প, কেউ আবার আনলেন অন্ধ্র-ওড়িশা-রাজস্থানের হস্তশিল্প। শুরুটা হয়েছিল এ ভাবেই। আর তার পরে বাড়তে বাড়তে বিষয়টি এমন জায়গায় পৌঁছল যে পুজোর সময়ে শহরে যেন শুরু হয়ে গেল হস্তশিল্পের প্রদর্শনী!
এখন অবশ্য থিমে মিশেছে শিল্পের তত্ত্ব, নান্দনিকতার দর্শনও। কিন্তু মণ্ডপ সাজাতে হস্তশিল্পের জারিজুরি কমেনি। উল্টে তা এগিয়ে নিয়ে যেতে কোথাও কোথাও উদ্যোগী হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও। পুজোকে কাজে লাগিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের পণ্যের প্রচার করছে, এমন দৃশ্যও বিরল নয়।
যেমন, এ বছর বিভিন্ন এফএম চ্যানেলে বাজছে জাতীয় পাট পর্ষদের বিজ্ঞাপন। পুজোয় পাটজাত পণ্য ব্যবহারের প্রচারকেই তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। জুট কমিশনার সুব্রত গুপ্ত বলছেন, ‘‘পাট পরিবেশবান্ধব। প্লাস্টিক-দূষণের বিরুদ্ধে তাই পাটজাত পণ্যকেই তুলে ধরছি।’’ সুব্রতবাবু জানান, পাটজাত পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়ায় আগের বছর শহরের একটি পুজোকে অর্থ সাহায্য করেছিলেন তাঁরা। এ বারও তেমন কথা চলছে।
এ বছর পাটজাত পণ্য ব্যবহার করছে শহরের আরও কিছু পুজো। যেমন ভবানীপুরের অগ্রদূত উদয় সঙ্ঘের থিম পাটশিল্প। পাটকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বাইপাসের আনন্দপুরের একটি পুজোতেও। কাঁথির এক শিল্পী সেখানে তৈরি করছেন পাটকাঠির মণ্ডপ। আনন্দপুরের পুজোকর্তারা বলছেন, পাটশিল্পকে তুলে ধরতে জুট বোর্ডের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা।
শহরের পুজোকর্তাদের অনেকেই বলছেন, থিম পুজোর চল শুরু হওয়া ইস্তক উৎসব কাপে হস্তশিল্পের প্রদর্শনী বসে যেত। বাঁকুড়ার পোড়ামাটি, পূর্ব মেদিনীপুরের পাট বা মাদুরকাঠির কাজ, তালপাতার লিপিকার, পটচিত্র— সবই উঠে আসতে। এক বার ভাঁড়ের মণ্ডপ করে তাজ্জব লাগিয়ে দিয়েছিল বোসপুকুরের এক ক্লাব। ভবানীপুরের এক পুজোকর্তা ঘুরতে গিয়ে একবার সিগারেটের প্যাকেটের পিছনে টেরাকোটার কাজ এঁকে এনেছিলেন। মণ্ডপে সেই কাজ ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাঁকুড়ার এক শিল্পী। সেই থেকে শুরু করে বারবারই উঠে এসেছে এমন সব হাতের কাজ। শুধু এ রাজ্য বা দেশ নয়, বছর দুই আগে হাতিবাগান নবীন পল্লি দেখিয়েছিল পাকিস্তানের ‘ট্রাক আর্ট’।
এ বার উৎসব কাপেও হস্তশিল্পের ‘পসরা’ সাজাচ্ছে ক্লাবগুলি। হালতুর পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘে রবার স্ট্যাম্পের আদলে মণ্ডপ গড়ছেন রবীন রায়। থাকছে ক্যালিগ্রাফি। বহু পুরনো পটশিল্প ও পটুয়ারা থাকছেন বিজয়গড়ের ভারতমাতা পুজো সমিতিতে। শিল্পী কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত মণ্ডপসজ্জার কাজে পটচিত্রের পাশাপাশি পটুয়াদের গান, লালনের গান ব্যবহার করছেন। প্রতিমা হচ্ছে ভারতমাতার আদলে। খোল, বাঁশি, একতারার মতো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের মডেলে সাজছে দেবদারু ফটকের মণ্ডপ। হস্তশিল্পকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছে হরিদেবপুর বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক ক্লাব। তাদের মণ্ডপ সাজছে ৭৫০ পড়ুয়ার হাতের কাজে। বিভিন্ন স্কুল ঘুরে এই সব হাতের কাজ জোগাড় করেছেন শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত। পুঁটিয়ারির পুজোয় থাকছে কাঠের কাজ। হস্তশিল্পের গুণেই হালসীবাগানে শিল্পী বাপ্পা হালদার আফ্রিকা, আমাজনকে মিশিয়ে দিচ্ছেন রাজস্থানের সঙ্গে।
হস্তশিল্প মেলায় শাড়ি থাকবে না, এমনটা আবার হয় নাকি! তাই পুজো ময়দানের হস্তশিল্পের লড়াইয়ে এ বার শাড়িকেই বেছে নিয়েছে ঠাকুরপুকুর ক্লাব। সেখানে শিল্পী দেবাশিস ভট্টাচার্য যেমন তাঁতের শাড়িকে তুলে ধরছেন মণ্ডপে। তাঁতিবাড়ির আদলে মণ্ডপ আর প্রতিমা হচ্ছে সাবেক রূপের। অনেকেই বলছেন, পাটশিল্প যেমন ধুঁকছে, তেমন ধুঁকছে তাঁত শিল্পও। পাটের উন্নতিতে জুট বোর্ড উদ্যোগী হলেও তাঁতের ক্ষেত্রে এখনও তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। লেকটাউনের অধিবাসীবৃন্দের পুজোয় আবার উঠে আসছে রেশম শিল্প।
বছর দশেক আগে পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে ডোকরার কাজ করে পুজো ময়দানে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ওই পাড়ারই এক যুবক। হয়ে উঠেছেন নামী শিল্পীও। নানা কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া পোস্তার পুজো অবশ্য সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে আর সেই নামী শিল্পীকে পায়নি। শিল্পী সত্যনারায়ণ হেমব্রম ও সুমন মণ্ডল মাটি, চট, খড়, নারকেল কাঠি দিয়ে সাজাচ্ছেন পোস্তার ওই ক্লাবের মণ্ডপ। ডোকরার কাজ দেখা যাবে বেহালা নন্দনা যুব সঙ্ঘের পুজোয়।
শহরের পুজো ময়দানের অনেক কর্তাই বলছেন, শহরের বিভিন্ন ভারী ভারী বিষয়ের থিম সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তার বদলে হস্তশিল্প মানুষকে অনেক বেশি টানে। কেউ কেউ আবার বলছেন, শহরের পুজো ময়দানে গুরুত্ব পেলে আয় বাড়ে হস্তশিল্পীদেরও। বছর দুয়েক আগে হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজো মণ্ডপে বস্তারের মোষের শিংয়ের শিল্প চমকে দিয়েছিল দর্শকদের। পুজো ময়দানের খবর, মণ্ডপে কাজ করতে আসা কারিগরেরা ছোটখাটো অনেক জিনিস বিক্রি করেছিল উৎসাহী লোকজনের কাছে। নিজেদের শিল্প তুলে ধরে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন আরও বড় জায়গায়। দেখেছেন আয়ের মুখও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy