Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

কলার ধরলেন কনস্টেবল, রব উঠল ‘ইয়ে চোর হ্যায়’

শিবরাত্রির ভিড়ের ছবি মিলবে। তাই সকাল বেলাই ক্যামেরা কাঁধে পৌঁছেছিলাম নিমতলা ঘাটের ভূতনাথ মন্দিরে। গোটা মন্দির চত্বর জুড়ে ভিড়ে ছয়লাপ, হুড়োহুড়ি। তারই মাঝে কোনও রকমে ছবি তুলছিলাম। এমন সময় দেখা হয়ে গেল পরিচিত এক পাণ্ডার সঙ্গে। ভিড়ের মধ্যেও ঠিক চিনেছিলেন উনি। বললেন, ‘‘দাদা ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে? না হলে চলুন ও দিকে, জানলার পাশে দাঁড়ালে ভাল ছবি পাবেন।’’

শিবরাত্রির পুজো। নিমতলা ঘাটে, ভূতনাথ মন্দিরে। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

শিবরাত্রির পুজো। নিমতলা ঘাটে, ভূতনাথ মন্দিরে। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

রণজিৎ নন্দী
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৮
Share: Save:

শিবরাত্রির ভিড়ের ছবি মিলবে। তাই সকাল বেলাই ক্যামেরা কাঁধে পৌঁছেছিলাম নিমতলা ঘাটের ভূতনাথ মন্দিরে। গোটা মন্দির চত্বর জুড়ে ভিড়ে ছয়লাপ, হুড়োহুড়ি। তারই মাঝে কোনও রকমে ছবি তুলছিলাম। এমন সময় দেখা হয়ে গেল পরিচিত এক পাণ্ডার সঙ্গে। ভিড়ের মধ্যেও ঠিক চিনেছিলেন উনি। বললেন, ‘‘দাদা ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে? না হলে চলুন ও দিকে, জানলার পাশে দাঁড়ালে ভাল ছবি পাবেন।’’

ওঁর দেখানো পথেই জানলার পাশে ভাল জায়গা পেলাম। চটপট ছবিও পেয়ে গেলাম। ছবি তোলা যখন হয়ে এসেছে তখনই ঘটল কাণ্ডটা!

মন্দিরে যে দরজা দিয়ে ভি়ড় বেরিয়ে যাচ্ছিল সেই দরজা দিয়েই ঢুকে এলেন কয়েক জন মহিলা। সঙ্গে পুরুষ। এক মহিলা সোজা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘ওই ছেলেটা, ওই ছেলেটা! ওই ক্যামেরা হাতে ছেলেটাই আমার কানের দুল ছিনিয়ে নিয়েছে!’’ কথাটা কানে ঢুকেছিল কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না। গলা চড়িয়েছেন আরও কয়েক জন মহিলা। কেউ বলছেন, ‘‘আমার গলার হার নিয়েছে।’’ কেউ বা বলছেন, ‘‘আমারও দুল নিয়েছে।’’ গলা চড়ছে সঙ্গে থাকা যুবকদেরও। এমন সময় যেন দেবদূতের মতো উদয় হলেন সেই পরিচিত পাণ্ডা। ওই মহিলাদের বললেন, ‘‘আরে, কাকে কী বলছেন? উনি চিত্র-সাংবাদিক। আমাদের পরিচিত।’’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? ওই পাণ্ডা বললেন, ‘‘এই দাদা আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। উনি কিছুই করেননি।’’ বাকি যুবকদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘মহিলাদের সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। ওঁদের সরিয়ে নিয়ে যাও।’’

সমস্যা মিটে গিয়েছে ভেবে আমিও মন্দির থেকে বেরোনোর পথ ধরি। সে সময়ই দেখি, ওই মহিলারা বাইরে দাঁড়ানো পুলিশকে কিছু বলছেন। হঠাৎই এক জন পুলিশ কনস্টেবল এসে সোজা আমার কলার চেপে ধরেন। তা দেখেই ওই মহিলাদের যেন গলার জোর বেড়ে গেল। বলতে লাগলেন, ‘‘ইয়ে আদমি চোর হ্যায়, ইয়ে চোর হ্যায়।’’ জুটে গেল আরও কিছু যুবক। তাঁদের মধ্যে দু’-এক জন মোবাইল ক্যামেরায় আমার ছবি তুলতে শুরু করলেন। যেন ‘চোর’ ধরা পড়েছে। এক জন এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘ইতনে সারে অউরত যব বোল রহি হ্যায় তব সার্চ করনা হি পড়েগা।’’

আরও পড়ুন:
‘মুম্বই কা কিং কৌন?’ ফল প্রকাশের পরে সব দল নিয়ে অঙ্ক কষছে শিবসেনা

ওই কথা শুনে হাত-পা যেন পেটের ভিতর সেঁধিয়ে গেল! তা হলে কি পুলিশের সামনেই জামাকাপড় খুলে আমাকে সার্চের নামে হেনস্থা করবে এই ছেলেগুলো! ওদের চোখমুখ দেখেও তো সুবিধের মনে হচ্ছে না! গোলমাল শুনে তত ক্ষণে মন্দির কমিটির লোকেরা হাজির হয়েছেন। ভেবেছিলাম, ওঁরাও হয়তো আমাকে হেনস্থাই করবেন। কিন্তু তা করলেন না। বরং ওই ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে কমিটির অফিসে নিয়ে বসালেন।

কী করব, কাকে ডাকব—কিছুই মাথায় আসছিল না। শেষমেশ অফিসেই ফোন করলাম। অফিস থেকে আশ্বাস মিলল। তা শুনে যেন ভরসা পেলাম।

সেই ভরসা যেন তালগোল পাকিয়ে গেল এ চিৎকারে। কমিটির অফিসের বাইরে কে যেন চিৎকার করে বলছিল, ‘‘বিজয়দা এসেছে, বিজয়দা এসেছে।’’ কে বিজয়দা? শুনলাম, উনি তৃণমূলের স্থানীয় নেতা। উনি এসেই চিৎকার জুড়ে দিলেন, ‘‘কোন ফোটোগ্রাফার মহিলাদের দুল ছিনতাই করেছে? দে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দে।’’ আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন ‘বিজয়দা’— ‘‘মন্দিরকা ভিডিও ফুটেজ দিখাও।’’

চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন সময় শুনলাম, ভিডিও ফুটেজেও কোনও চুরির দৃশ্য দেখতে পাননি বিজয়দা। তা শুনেই আস্তে আস্তে সরে পড়লেন উনি। ইতিমধ্যেই মন্দির কমিটির অফিসে ঢুকলেন এক পুলিশ ইন্সপেক্টর। বললেন, ‘‘রণজিৎ নন্দী কে?’’ তবে কি সত্যিই আমাকে পুলিশে ধরবে?

না। ওঁরা আমাকে ধরেননি। বরং অফিসের ফোন পেয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, ভরসা দিয়েছেন। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে হাঁটা দিয়েছি অফিসের পথে। ছবি তুলতে গিয়ে বহু বার নানা বিপদ, গোলমালে পড়েছি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ভূতনাথ মন্দিরেও আকছার যাই। সেই চেনা জায়গায় কাজে এসে এ ভাবে চোরের অপবাদ পাব, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Photographer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE