Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

শ্রাদ্ধের আগের দিন মায়ের কাছে ফোন এল ‘মৃত’ ছেলের

মিল বলতে ছিল বয়স আর উচ্চতা। সেই সঙ্গে পচাগলা দেহের থুতনি, সরু গোঁফ আর নাক দেখে দমদমের পূর্ব সিঁথির বিধানপল্লির মালাকার পরিবার নিশ্চিত হয় যে, দেহটি তাদের নিখোঁজ ছেলে শঙ্করেরই। শনাক্তকরণের পরে বেলুড় জিআরপি দেহ তুলে দেয় পরিবারের হাতে। সৎকারও করা হয়। আজ, বুধবার বাড়ির কাছে মন্দিরে বছর সাতাশের সেই ছেলের পারলৌকিক ক্রিয়ার আয়োজনও সারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

মিল বলতে ছিল বয়স আর উচ্চতা। সেই সঙ্গে পচাগলা দেহের থুতনি, সরু গোঁফ আর নাক দেখে দমদমের পূর্ব সিঁথির বিধানপল্লির মালাকার পরিবার নিশ্চিত হয় যে, দেহটি তাদের নিখোঁজ ছেলে শঙ্করেরই। শনাক্তকরণের পরে বেলুড় জিআরপি দেহ তুলে দেয় পরিবারের হাতে। সৎকারও করা হয়। আজ, বুধবার বাড়ির কাছে মন্দিরে বছর সাতাশের সেই ছেলের পারলৌকিক ক্রিয়ার আয়োজনও সারা।

সোমবার রাতে যখন ছেলের পারলৌকিক ক্রিয়া কী ভাবে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখনই এসেছিল ফোনটা। আর সেই ফোনেই বদলে গেল শোকস্তব্ধ বাড়ির পরিবেশ।

শঙ্করের বাবা কার্তিক মালাকারের মোবাইলে বিহারের নওয়াদা জেলার সিতাম্বরী থানা থেকে ফোন করেছিলেন উপেন্দ্র সিংহ নামের এক পুলিশ অফিসার। তিনিই জানান, বছর সাতাশের এক অসুস্থ যুবককে উদ্ধার করেছেন তাঁরা। সেই যুবকের কাছ থেকেই কার্তিকবাবুর ফোন নম্বর মিলেছে। যুবককে তাঁরা চেনেন কি না, দেখতে বলেন অফিসার।

প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু ফোনে শঙ্করের গলা শুনেই ভুল ভাঙল। এক মাস বাদে ছেলের সঙ্গে কথা হল মায়ের। কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে ভুল হয়নি। ফোন রেখে দেওয়ার পরে তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না কার্তিকবাবুর। রাতেই তাঁরা ছোটেন দমদম থানায়। সব ঘটনা জানিয়ে কার্তিকবাবু ও তার কয়েক জন আত্মীয় রওনা দেন বিহারে। মঙ্গলবার পৌঁছে সিতাম্বরী থানাতেই শঙ্করের দেখা পান তাঁরা।

শঙ্করদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের হার্ডওয়্যারের ব্যবসা রয়েছে। ওই যুবকের জামাইবাবু সঞ্জীব কর্মকার জানান, গত ৯ জুন ভোর ৫টার সময়ে মাকে দোকান খুলতে যাচ্ছেন জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন শঙ্কর। তার পরে আর ফেরেননি। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে থানা, হাসপাতাল, মর্গ কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি পরিবার। দমদম থানা ও ভবানী ভবনের মিসিং পার্সন্স স্কোয়াডেও ডায়েরি করেন পরিজনেরা। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় শঙ্করের ছবি-সহ পোস্টারও লাগানো হয়। কিন্তু কোথাও খোঁজ মেলেনি। পরিবারের দাবি, আট মাস আগে শঙ্করের বিয়ে হয়েছিল। তার এক মাস পরেই শঙ্করের স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এর পরেই শঙ্কর মনমরা হয়ে পড়েন। ওই যুবক নিখোঁজ হওয়ার পরে তিনি দুর্ঘটনায় পড়েছেন কি না, তা নিয়েও আশঙ্কায় ছিল পরিবার।

সঞ্জীববাবু জানান, গত ৫ জুলাই লালবাজার থেকে তাঁদের ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে বিভিন্ন মৃতদেহের ছবি দেখান অফিসারেরা। তার মধ্যে একটি দেহের বয়স, উচ্চতা শঙ্করের সঙ্গে বেশ কিছুটা মিলে যাচ্ছিল। লালবাজারের কর্তারা জানান, ওই দেহ রয়েছে বেলুড় জিআরপি-র মর্গে।

কিন্তু বেলুড়ের মর্গে সেই মৃতদেহ এতটাই পচাগলা অবস্থায় ছিল যে, প্রথমে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। পরে থুতনি, গোঁফ আর নাক দেখে পরিবার নিশ্চিত হয় যে, দেহটি শঙ্করেরই। জিআরপি-র অফিসাররা জানান, ১২ জুন বালিতে রেল দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। শঙ্করও তাঁর আগেই নিখোঁজ হন। ফলে সময়ও মিলে যায়।

সে দিনই মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বিধানপল্লির বাড়িতে। ৬ জুলাই রতনবাবুর ঘাটে সৎকারের কাজও করা হয়। বাড়ির কাছে মন্দিরে পুরোহিত ডেকে বুধবার পারলৌকিক ক্রিয়ার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সোমবার রাতে পারলৌকিক কাজের অনুষ্ঠানের বিষাদই পাল্টে গেল ছেলেকে ফিরে পাওয়ার অপ্রত্যাশিত আনন্দে।

সোমবার রাতে রওনা হয়ে মঙ্গলবার সকালে সিতাম্বরী থানায় ছেলেকে দেখতে পান কার্তিকবাবু। ফোনে বলেন, “ছেলেকে না পেয়ে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। কতক্ষণে যে ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাব!” কার্তিকবাবু জানান, বুধবার ভোরেই তাঁরা দমদম পৌঁছে যাবেন।

বিহারের সিতাম্বরী থানার এএসআই সুমনকুমার রানা বলেন, “ছেলেটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রাতে এক অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁর পরে ওর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটির পরিবারের লোকজন এসেছে। তাঁরা ছেলেকে শনাক্ত করেছেন। সমস্ত প্রমাণ মেলার পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।”

কেন বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন শঙ্কর? এত দিন কোথায় ঘুরেছেন, সে সব নিয়ে এখনও কিছু বলতে পারেননি অসুস্থ যুবক। শুধু বলেন, “পিসির বাড়ি যাব বলে ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি। খেতে পাইনি। শেষে এক পুলিশ অফিসার আমাকে থানায় নিয়ে যান। মা-কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

shankar east sinthi condolance belur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE