রঙিন: শহরের কিছু জায়গায় দেখা মিলছে শিমুলের মতো ফুলের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সে যে কখন আসত যেত জানতে পেতেম না যে, হয়তো মনের মাঝে সংগোপনে দিত নাড়া…’। যাই-যাই শীতের এই অদ্ভুত সময়টা কলকাতাও কি আজকাল আর টের পায়? যে শহরে উত্তর থেকে দক্ষিণ— সর্বত্রই সবুজ কোণঠাসা, সেখানে কোকিলই বা ডাকবে কী করে, শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়াই বা ফুটবে কোথায়? বসন্তের বার্তাবাহীদের দেখা পেতে হলে এখন তাই ময়দানের মতো কোথাও যাওয়া ছাড়া গতি নেই। অথবা শহরের বাইরে। কলকাতার কোনও কোনও পাড়ায় এখনও পলাশ বা কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে ঠিকই, তবে তা হাতে গোনা। কংক্রিটের জঙ্গলে বসন্ত আর সে ভাবে ঢুকতে পারে না যে!
ফুল ফুটুক না ফুটুক, বসন্তের উদ্যাপন অবশ্য তাতে থেমে থাকে না। বসন্তের কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠান হয়, বসন্তের গান নিয়ে বসে জলসা। বসন্তের ‘রোম্যান্টিসিজম’ নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়। কিন্তু বসন্ত আসলে কেমন, এ শহরের কাছে তা বোধহয় অজানাই থেকে যায়। এ শহরের শিশুরা তাই কোকিলের ডাক শোনে ইউটিউব থেকে। শিমুল, পলাশ চেনে ছবির বই দেখে।
কিন্তু সর্বত্রই কি তা-ই?
সল্টলেকের বাসিন্দা, কবি জয় গোস্বামী অবশ্য তা মনে করেন না। সেখানে সকালের রোদ বা সন্ধেবেলার হাওয়া, সব কিছুই তাঁকে মনে করিয়ে দেয় যে, বসন্ত এসে পড়েছে। জয়ের কথায়, ‘‘এখন চার দিকে কেমন একটা দোল-দোল আবহাওয়া। এই সময়ে খুব শান্তিনিকেতনে যেতে ইচ্ছে করে আমার। সল্টলেকের যেখানে আমি থাকি, সেখানে অনেক গাছপালা রয়েছে। তাই আমি বসন্তের আগমন বেশ টের পাই। এই সময়ে রোদের রংটা অন্য রকম হয়ে যায়। সেই রোদ যখন গাছের পাতায় পড়ে, তখন বেশ বুঝতে পারি, এখন বসন্তকাল। আমি কিন্তু এখানে কোকিলের ডাকও শুনেছি।’’
বসন্তের বাহ্যিক পরিবর্তন কি মনেও তার প্রভাব ফেলে?
জয়ের মতে, ‘‘এখন আর মনের তেমন কোনও পরিবর্তন টের পাই না। তবে বাহ্যিক পরিবর্তনটা বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু রানাঘাটে যখন
থাকতাম, তখন বসন্তকালের পরিধিকে আরও অনেক বেশি করে অনুভব করতাম। মনেরও একটা পরিবর্তন টের পেতাম তখন।’’
কলকাতা শহরে কিন্তু বসন্তের পদধ্বনি সে ভাবে শুনতে পান না ‘বসন্ত এসে গেছে’ খ্যাত অনুপম রায়। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতায় আসলে বসন্তকালটা এখন যে কোনও সিজন চেঞ্জের মতোই হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা থেকে খুব গরম পড়ার আগের একটা সময়। বসন্ত এল মানেই ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি-জ্বর দেখা দেবে। আর বুঝতে পারব, আবার সেই বাজে গরমটা পড়তে চলেছে। আগে কিন্তু বসন্তকালটা বেশ দীর্ঘ ছিল। এখন যেন শীত যেতে না যেতেই গরম পড়ে যায়। জনসংখ্যা আর দূষণও বোধহয় এর জন্য দায়ী।’’
বসন্ত না এলেও বসন্তের গান তো আছে?
অনুপম বলেন, ‘‘আসলে শিল্পীদেরও তো একটা উপলক্ষের প্রয়োজন হয়। সেই কারণেই বসন্ত আসুক বা না আসুক, বসন্তের গান নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হয়।’’
আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের কাছেও কিন্তু এ বছর কলকাতার বসন্তকাল সে ভাবে ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ছে না। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, তাঁদের হিসেবে এ বছর কলকাতায় বসন্তকালের দৈর্ঘ্য এতই কম যে, তা প্রায় আসেনি বললেই চলে। সঞ্জীববাবুর কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, শীতের দৈর্ঘ্য যদি বেশি হয়, তা হলে বসন্তের দৈর্ঘ্য খুব কম হবে। শীত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে বসন্তকে উপভোগ করার একটা সম্ভাবনা থাকে। এ বছর কলকাতায় লম্বা শীত পেয়েছি আমরা। তাই বসন্তকে বেশি দিন পাব না।’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি এক জন লিখেছিলেন, বসন্ত এসে গেছে ঠিকই, তবে তা শুধুই ফেসবুকে।
বাইরে তার দেখা মেলা ভার। ফেব্রুয়ারি শেষে রোদের তাপও কিন্তু সে কথাই বলছে। বসন্ত এসেছে ঠিকই, তবে শুধুই গ্রীষ্মের মুখবন্ধ হয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy