অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
রাস্তার ধারে নিশ্চিন্তে জলবিয়োগ করছিলেন এক জন। হঠাৎই তাঁর মনঃসংযোগ ভেঙে এসে থামল লালবাতিওয়ালা একটি গাড়ি। নেমে এলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তি। রাস্তা থেকে গাছের ভাঙা ডাল কুড়িয়ে মারতে শুরু করলেন ওই যুবককে। চিৎকার করে বললেন, ‘‘তোমার লজ্জা করে না? এ ভাবে নোংরা করছ কলকাতাকে?’’
তাঁকে নিরস্ত করার সাহস দেখালেন না কেউই। তিনি যে কলকাতার মেয়র!
অনেক দিন আগের ঘটনা। এ ভাবেই কলকাতাকে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। এখন সেই মেয়রও নেই, আর অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে সেটুকু মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন মনে করেন না কেউ। পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলেছেন সকলে। কেউ বা নাকে কাপড় চেপেই সেরে নিচ্ছেন ‘কম্মো’। তাই কলকাতার প্রাণকেন্দ্র এখন প্রস্রাবাগার। শরতের হাওয়ায় ছাতিম ফুলের বদলে শুধুই অ্যামোনিয়ার কটু গন্ধ।
শৌচালয় না থাকলে মানুষ কোথায় যাবে, মনে হয়েছিল সে দিনের সেই মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তাই সে সময়ে তিনি শহর জুড়ে একটি সমীক্ষা করান। সেই সমীক্ষার ফলাফল বলেছিল, কলকাতায় সাড়ে পাঁচ হাজার নতুন শৌচালয় দরকার। সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘১৯০০টি শৌচালয় তৈরি হওয়ার পরে আমি চলে যাই। তার পরে বোধহয় নতুন করে বেশি কিছু হয়নি।’’
ধর্মতলা থেকে ডাফরিন রোড হয়ে প্রেস ক্লাবের পাশ দিয়ে মেয়ো রোড থেকে বাঁ হাতে ঘুরলেই জওহরলাল নেহরু রোড। গাছপালায় ছাওয়া ফুটপাথগুলো দেখলেই মন ভরে যাবে, কিন্তু হাঁটতে গেলেই বিপত্তি। ফুটপাথের পাশে যত্রতত্র ছড়িয়ে মল-মূত্র-জঞ্জাল। কোথাও কোথাও সে সব ছড়িয়ে গিয়েছে রাস্তায়। পূতিগন্ধে ভারী বাতাস। জঞ্জালের মাঝখান দিয়েই নাকে কাপড় চেপে হাঁটছেন পথচারীরা। কেউ বা সেই নোংরা টপকাতে না পেরে ফিরে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরছেন। অথচ এখানেই তিরিশ হাত অন্তর তিনটি শৌচালয়। এক পথচারী বললেন, ‘‘এই জায়গাটা আগে কত সুন্দর ছিল। এত গাছপালা এ দিকে! অফিস সেরে বিকেলের দিকে কিছুক্ষণ হাঁটলেই ক্লান্তি উধাও হয়ে যেত। আর এখন নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। পুরো ‘মল’ কালচার!’’
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এই অঞ্চলের এমন দশা কেন?
ফুটপাথের উপরেই যে সব ব্যবসায়ীর দোকান, তাঁরা জানাচ্ছেন, ডাফরিন রোডের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রচুর দূরপাল্লার বাস। সে সব বাসের চালক, খালাসি থেকে শুরু করে সাধারণ যাত্রীরাও একটু ‘হাল্কা’ হওয়ার জন্য বেছে নেন রাস্তার ধার। গাড়ি থামিয়েও অনেকে দাঁড়িয়ে যান।
কিছু বলেন না কেন? ব্যাগের ব্যবসায়ী মহম্মদ সইদ বললেন, ‘‘বলেছি। লাভ হয় না। বেশি বললে লোকজন পাল্টা হুমকি দেয়, ‘রাস্তার উপরে দোকান করে আছ। বেশি কথা বোলো না।’ লাজলজ্জা কিছুই নেই এদের।’’ প্রেস ক্লাবের সামনে দীর্ঘ দিনের দোকান অরুণ চৌধুরীর। তিনি জানান, পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের নীচে এবং রাস্তার পাশে গাছগাছালি ঘেরা ফাঁকা জায়গায় ভিড় জমান প্রচুর ভবঘুরে। এঁরা সারা দিন কলকাতা জুড়ে নানা কাজকর্ম করেন। কেউ কাগজ কুড়োন, কেউ বা মোট বহন করেন আবার কেউ বা ভিক্ষে করেন। রাতে শোয়ার সময়ে এঁরা জড়ো হন। ভোর না হতেই এঁদের বর্জ্যে সেজে ওঠে ফুটপাথ। তবে কম যান না পথচলতি মানুষও। অরুণবাবুর কথায়, ‘‘গাছ দেখলেই এঁরা দাঁড়িয়ে যান। কী মজা পাওয়া যায় কে জানে? গন্ধে আমরাই অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাইরে থেকে কত লোকজন আসে। লজ্জায় মাথা কাটা যায় আমাদের। পুরসভার তো ভ্রূক্ষেপই নেই। দিনের পর দিন এ ভাবেই পড়ে থাকে। পরিষ্কার হয় না।’’
পুরসভা যদিও গাফিলতির কথা মানতে নারাজ। মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল) দেবব্রত মজুমদার বলেন, ‘‘রাস্তা তো রোজই পরিষ্কার করে আমাদের লোক।’’ অন্য এক মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার যদিও এর জন্য দায়ী করছেন সাধারণ মানুষকেই। তিনি বলেন, ‘‘পুরসভা তো শৌচাগার করে দিয়েছে। তা-ও যদি কেউ রাস্তায় করে, কী করব বলুন তো? আমরা তো পুলিশ নই। এটা সচেতনতার ব্যাপার। রোজ তিনবেলা করে পরিষ্কার করা হচ্ছে। তা-ও নোংরা করে দিচ্ছে। আমি হতাশ।’’
কাছাকাছি শৌচালয় থাকলেও যে মানুষজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ছেন, সে নজির কম নেই। কেন এই বদভ্যাস?
মনোবিদ সুদীপ বসু জানান, এ দেশে ছোটবেলা থেকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস তৈরি করানো হয় না। স্কুল এবং মা-বাবা এর জন্য দায়ী। বাড়িতে মা-বাবা শৌচাগার পরিষ্কার করেন, অথচ বাচ্চাকে করতে দেন না। বাড়িতে তো বটেই, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সপ্তাহে এক দিন করে বাচ্চাদের দিয়ে শৌচালয় সাফ করানো উচিত। তিনি বলেন, ‘‘এতে দায়বদ্ধতা বাড়ে। নোংরা করার প্রবণতা কমে। পুরোটাই অভ্যাস এবং সচেতনতার ব্যাপার।’’
একটু দূরেই সুলভ শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও মঙ্গলবার দুপুরেও রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন এক ব্যক্তি। ‘‘কাছেই তো শৌচালয়। এখানে কেন?’’ জিজ্ঞেস করায় একগাল হেসে বললেন, ‘‘ওখানে তো ফালতু দু’টো টাকা খরচ। লাইন দিতে হবে। তা ছাড়া যা দুর্গন্ধ! কে যাবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy