Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪

পুজো আসে পুজো যায়, কেউ নিতে আসে না ওঁদের

চিকিৎসকেরা কবেই জানিয়ে দিয়েছেন ওঁরা সুস্থ। তবু এখনও ওঁদের ঠিকানা পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। পুজোর দিনগুলোতেও তাই ওঁদের ঠিকানা বদলায় না।

সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ১৮:৩৯
Share: Save:

চিকিৎসকেরা কবেই জানিয়ে দিয়েছেন ওঁরা সুস্থ। তবু এখনও ওঁদের ঠিকানা পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। সুস্থ হওয়ার পর সুভাষ ঘোষ, প্রভাত ঘোষ, নীতা দাসরা কাটিয়ে ফেলেছেন অন্তত দশটা বছর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার চিঠি পাঠিয়েছেন বাড়ির লোকের কাছে। কিন্তু আজও কেউ আসেননি ওঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। পুজোর দিনগুলোতেও তাই ওঁদের ঠিকানা বদলায় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, একাধিকবার চিঠি লেখার পরেও এঁদের বাড়ি থেকে কেউ যোগাযোগ করেন না। ক্রমশ এঁরা তাই হাসপাতালের এক প্রকার স্থায়ী বাসিন্দাই হয়ে গিয়েছেন।

পুজোর ক’দিন স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে রোগীর জন্য নতুন জামাকাপড়, ভাল খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত হয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে একদিন বাসে চড়ে ঠাকুর দেখতেও যান ওঁরা। আর তাতেই যেন আরও বেশি করে উস্কে ওঠে স্মৃতি। সুস্থ হয়ে ওঠা মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায় জানিয়েছেন, সুস্থ হওয়ার পর বাড়ির লোক ফিরিয়ে নিয়ে যাননি, এমন অনেকেই ছড়িয়ে আছেন বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে। তবে তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা এঁরাই।

সুভাষ ঘোষের বাড়ি বউবাজার। ৮০ সালের মাধ্যমিকে ‘ফার্স্ট ডিভিশন’। ৯০ তে কলকাতা পুরসভায় চাকরি। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়তেন বলে ২০০১ সালে বাড়ির লোকেরা ভর্তি করে দিয়েছিলেন হাসপাতালে। ২০০৩ সালে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন তিনি সুস্থ। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি। সুভাষবাবু জানান, আগে বাড়ির লোকেরা মাঝেমধ্যে এখানে আসতেন। যতবারই তাদের বলেছেন বাড়ি ফিরতে চান, উত্তর এসেছে, ‘পরেরবার ঠিক নিয়ে যাব।’ কিন্তু এই বার বছরে সেই পরেরবারটি আর আসেনি।

সুভাষবাবু জানান, যখন চাকরি করতেন প্রত্যেকবার পুজোয় দুই ভাইঝিকে জামা কিনে দিতেন। তিনি বলেন, ‘‘জানি ওরা আর আসবে না। আর যদিও বা আসে আমার তো এখন জামা কিনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। পুজোর সময় খালি হাতে লজ্জা করবে। তার চেয়ে না আসাই ভাল।’’

বাগবাজারের গোঁসাই লেনে থাকতেন নীতা দাস। রেডিও সারানোর কাজ করতেন। সেই সময়েই পাড়ার একটি ছেলের প্রেমে পড়েন নীতাদেবী। জানালেন, নিজের পড়াশোনা বিশেষ হয়নি তবু প্রেমিককে সারাক্ষণ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। অভাবের সংসার থেকে টাকা বাঁচিয়ে নিয়মিত যোগান দিয়েছেন হাতখরচের। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিনে দিয়েছেন একের পর এক বই। পরিশ্রম সার্থক হয়েছিল তাঁর। প্রেমিক চাকরি পেয়েছিল ব্যাঙ্কে। কিন্তু প্রেমিক বিয়ে করেছিলেন অন্যত্র। আর নীতাদেবীকে ভর্তি হতে হয়েছিল পাভলভে। বছর দুয়েকের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তারপর কেটে গিয়েছে দশ বছর।

পদ্মপুকুরের বাসিন্দা প্রভাত ঘোষ। নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন, রীতিমতো তালিম নিতেন গানের। মাথায় চোট পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাভলভে। সুস্থ হওয়ার পর কেটে গিয়েছে ১৪ বছর। এখন তিনি এবং সুভাষবাবু মিলে সকালে রোগীদের খাবার দেন। তারপর টুকটাক গল্পগাছা করে আর গান গেয়ে কেটে যায় সারাদিনটা।

প্রভাতবাবু জানান, অনেকদিন আগে পুজোর সময় ঘুরতে বেরোতেন বন্ধুদের সঙ্গে। মাকে কিনে দিতেন শাড়ি। মা বেলারানি ঘোষ ৯৪ বছরের বৃদ্ধা। চোখে দেখেন না কিছুই। পক্ষাঘাতে পঙ্গু। বছর কয়েক আগে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে পুজোর সময় দেখা করতে গিয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে। সেদিন অন্ধ মা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দু’হাতে মেখেছিলেন প্রৌঢ় ছেলের স্পর্শ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাড়ির ছেলেকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরাতে উদ্যোগী হননি কেউই।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে শুভার্থী মুখোপাধ্যায় জানান, ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি হাসপাতালের মধ্যেই ছোট্ট চায়ের দোকান চালায়। এখন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সেখানেই টুকটাক কাজ করেন নীতাদেবী। ওই সময়টুকুই মুক্তি। তারপর আবার গরাদের ভিতরে। তিনি জানান, এমনিতে কেটে যায় গতানুগতিক জীবন। কিন্তু পুজো এলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় সেইসব দিনগুলোর কথা। বলেন, ‘‘পুজো এলেই বরং কষ্ট। আগে মামারবাড়ির লোকজন দেখা করতে আসত। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওরাও আসে না। আমাকে তো বেরোতে দেয় না, নইলে আমি নিজেই চলে যেতাম।’’

তবে নীতাদেবী এবং সুভাষবাবু বাড়ি ফেরার আশা ছেড়ে দিলেও আশা ছাড়েননি প্রভাতবাবু। স্বপ্ন দেখেন এই পুজোয় না হলেও পরের পুজোয় নিশ্চয়ই কেউ আসবে বাড়ি থেকে। ফিরিয়ে নিয়ে যাবে মায়ের কাছে। আবারও মায়ের জন্য কিনে আনবেন নতুন শাড়ি। কথা বলতে বলতে চুপ করে যান প্রভাতবাবু। গরাদের ভেতরে ঝাপসা আলোয় হঠাৎই গুনগুনিয়ে ওঠেন তিনি, ‘‘সময় যে তার হল গত/ নিশি শেষের তারার মতো/ হল গত....।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE