সরকারি হাসপাতাল এখন রোগীদের জন্য দেড়-দু’লক্ষ টাকার ওষুধও নিখরচায় সরবরাহ করছে। অথচ গত চার বছর ধরে লিফ্ট বসানো যাচ্ছে না বলে কারণ দেখিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো নামী সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ‘রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিট’-এর মতো অতি জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে রেখেছেন! অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়েছে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের।
দূরের জেলা থেকে শ্বাসকষ্টের রোগী মেডিক্যালে এলেই পত্রপাঠ তাঁকে অন্য হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে বা মৌখিক জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এই পরিষেবা মেডিক্যালে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে খাবি খাওয়া রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোক ছুটছেন অন্য হাসপাতালে।
যেখানে সরকারি হাসপাতালে একটি ভেন্টিলেটর পাওয়ার জন্য মুমূর্ষু রোগীদের পরিজনেদের কাড়াকাড়ি চলে, সেখানে মেডিক্যালের ওই অচল ইউনিটে স্রেফ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে ৮-৯ লক্ষ টাকা দামের তিনটি আধুনিক ভেন্টিলেটর! অভিযোগ, হাসপাতালের অন্য বিভাগে নিয়ে গিয়ে সেগুলো ব্যবহার করার কোনও চেষ্টাই দেখাননি কর্তৃপক্ষ। তালাবন্ধ পড়ে রয়েছে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের উপযোগী আরও অনেক জরুরি, দামি যন্ত্রপাতিও।
অথচ, চিকিৎসকের সংখ্যা ও পরিকাঠামোর দিক দিয়ে কলকাতা মেডিক্যালের বক্ষ রোগ বিভাগ রাজ্যের অন্য সব মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে বৃহত্তম। বিভাগের পরিষেবার এই হাল যাঁদের জানা নেই, অনেক আশা নিয়ে এসে তাঁরা হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন। পুজোর আগে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে শ্বাসকষ্টের রোগীদের সমস্যা এমনিতেই বাড়ে। গোটা শীতকালই তা চলে। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মেডিক্যালে রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিটে ভর্তির জন্য হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনাইটিস, সিওপিডি, ‘অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিম্পটম’-এ আক্রান্তরা আসতে শুরু করেন। প্রত্যাখ্যাত ওই রোগীদের দুর্দশা দেখে আর থাকতে না পেরে পুজোর ঠিক মুখে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন, হাসপাতালের বক্ষ বিভাগেরই কিছু জুনিয়র ডাক্তার এবং কয়েক জন প্রাক্তন ছাত্র।
অভিযোগকারীদের দাবি ছিল, অতীতেও একাধিক বার রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিটের অবস্থা, ভেন্টিলেটরগুলির হাল এবং বক্ষ বিভাগের ইমার্জেন্সি পরিষেবার দুরবস্থা নিয়ে মুখ খুলতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিভাগের কিছু সিনিয়র চিকিৎসক তাঁদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া এবং কেরিয়ার নষ্ট করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু এ বার আর তাঁরা চুপ করে থাকতে পারছেন না।
মাস তিনেক আগে এই বক্ষ বিভাগের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন মেডিক্যালেরই মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা। অভিযোগ ছিল, বছরের পর বছর বক্ষ বিভাগ ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করে না। মোটামুটি বিকেল তিনটের পরে ইমার্জেন্সিতে বক্ষ রোগে আক্রান্ত কেউ এলেই তাঁকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল মেডিসিন বিভাগে। আর বক্ষ বিভাগের চিকিৎসকেরা বাড়ি চলে যাচ্ছিলেন। ২২ জন পিজিটি এবং যথেষ্ট সংখ্যক প্রোফেসর থাকা সত্ত্বেও কেন একটা বিভাগ ইমার্জেন্সি পরিষেবা দেবে না, তা নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। চাপের মুখে ভুল স্বীকার করে ইমার্জেন্সি চালুর কথা ঘোষণা করেন বক্ষ বিভাগের প্রধান সুমিত্রা বসুঠাকুর। কিন্তু তাঁর বিভাগেরই জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ অভিযোগ করেছেন, এখনও জরুরি পরিষেবা যথাযথ ভাবে শুরু হয়নি।
শুধু তা-ই নয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ওয়েবসাইটে ফলাও করে বক্ষ বিভাগে ‘ফাইবার অপটিক ব্রঙ্কোস্কপি’ পরিষেবার কথা দেওয়া থাকলেও হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই পরিষেবার অবস্থাও তথৈবচ। অভিযোগ, চিকিৎসক ও জুনিয়র ডাক্তারদের ব্রঙ্কোস্কপি করার প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় না। এটা জানেন মোটে ২ জন। ফলে সারা বছর নামমাত্র রোগীর ব্রঙ্কোস্কপি হয়। ২০১৫-র কথাই ধরা যাক। ওই বছর এসএসকেএম হাসপাতালে ২১৬ জনের ব্রঙ্কোস্কপি হয়, আরজিকরে ৪৫০ জনের। অথচ বৃহত্তম পরিকাঠামো নিয়ে মেডিক্যালের বক্ষ বিভাগে ওই বছর মাত্র ৪১টি ব্রঙ্কোস্কপি হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রেরই খবর, মাসে তিনটির বেশি ব্রঙ্কোস্কপি এখানে হয় না। অর্থাৎ বছরে সংখ্যাটা মাত্র ৩৬ থেকে ৪৫-এর মধ্যে থাকে।
সব শুনে ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘স্বাস্থ্যে অঢেল টাকা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। এত দামি ওষুধ-চিকিৎসাসামগ্রী দিচ্ছি আমরা, বড়-বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, আর এঁরা লিফট হচ্ছে না বলে রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিট বন্ধ রেখেছেন? ভেন্টিলেটর ফেলে রেখেছেন! এঁরা তো এত দিন এ সব কিচ্ছু জানাননি! ব্রঙ্কোস্কপিরও এই দশা! এক বছরে একটা মেডিক্যাল কলেজে মোটে ৪১টা! এ ভাবে আর চলবে না।’’
মেডিক্যালের বক্ষ বিভাগের প্রধান সুমিত্রা বসুঠাকুরের জবাব, ‘‘যে ভবনে রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিট রয়েছে, সেখানে লিফ্ট-সহ কিছু কাজ বাকি। পিডব্লিউডি তা শেষ না করলে ইউনিট চালু হবে না। কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়েছি। আর ভেন্টিলেটর অন্য কোনও বিভাগে দিলে যখন আমাদের ইউনিট চালু হবে তখন আর সময়মতো ফেরত না-ও পেতে পারি। সেই আশঙ্কাতেই ওগুলি ব্যবহার না করে রেখে দেওয়া হয়েছে।’’ আর ব্রঙ্কোস্কপি-র সংখ্যার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ‘‘আপনাদের কৈফিয়ত দেব না।’’
এত বছর ধরে লিফট লাগানো গেল না কেন? এ প্রসঙ্গে সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি যখন হাসপাতালে এসেছি, তখন ওই ভবনে অক্সিজেন লাইন আসেনি। তা আনতে সময় লেগেছে। লিফ্টের জন্য স্বাস্থ্যভবনে চিঠি লিখেছি। সরকারি কাজে সময় লাগে।’’ ব্রঙ্কোস্কপি বিষয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে ক’টা হচ্ছে, তা যথেষ্ট। আপনাদের ভাবতে হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy