Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

পাশে হাসপাতাল, কোলে ফিরল মেয়ে

এ দিকে, হাসপাতালে টানা কয়েক মাসের চিকিৎসায় সেরে ওঠেন মা। বাড়ি ফিরে জানতে পারেন, সন্তানের ঠাঁই হয়েছে হোমে। এই যন্ত্রণা ফের তাঁকে মানসিক অবসাদের দিকে ঠেলে দিতে পারত। কিন্তু দেয়নি। বরং একটা জেদ চেপে বসেছিল— যে করেই হোক, সন্তানকে কাছে পেতে হবে।

মমতা: মেয়ের সঙ্গে পম্পাদেবী।

মমতা: মেয়ের সঙ্গে পম্পাদেবী।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০২:৩০
Share: Save:

গোটা হাসপাতাল এককাট্টা হয়ে মিলিয়ে দিল মা-মেয়েকে!

পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা চলছিল মায়ের। মুম্বইবাসী বাবার বক্তব্য ছিল, তাঁর সন্তান ভবিষ্যতে যাতে কোনও ভাবেই ‘পাগল’ মায়ের তত্ত্বাবধানে না থাকে, তার ব্যবস্থা হোক। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগও জানিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় শিশুটিকে। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির তত্ত্বাবধানে তার স্থান হয় মধ্যমগ্রামের একটি হোম-এ।

এ দিকে, হাসপাতালে টানা কয়েক মাসের চিকিৎসায় সেরে ওঠেন মা। বাড়ি ফিরে জানতে পারেন, সন্তানের ঠাঁই হয়েছে হোমে। এই যন্ত্রণা ফের তাঁকে মানসিক অবসাদের দিকে ঠেলে দিতে পারত। কিন্তু দেয়নি। বরং একটা জেদ চেপে বসেছিল— যে করেই হোক, সন্তানকে কাছে পেতে হবে। কিন্তু এই লড়াইয়ে কাকে পাশে পাবেন তিনি? ফিরে যান হাসপাতালেই। আর এই লড়াইয়ে তাঁর সহায় হয় গোটা হাসপাতাল। যেখানে‌ রোগীদের প্রতি অবহেলার হাজারো অভিযোগ ওঠে সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে, প্রতি দিন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র অভিযোগে বিদ্ধ হন মানসিক হাসপাতালের কর্তারা, সেখানে তেমনই একটি হাসপাতালের সামগ্রিক ভাবে উদ্যোগী হয়ে মা-সন্তানকে মিলিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে নজিরবিহীন বলছেন অনেকেই।

আরও পড়ুন: একটানা বৃষ্টিতে যানজট, ভোগান্তি

ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, বছর পঁয়ত্রিশের পম্পা গুহ নার্সিং প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে কাজের খোঁজে মুম্বই গিয়েছিলেন। সেখানে একটি বাড়িতে এক বৃদ্ধের নার্স হিসেবে কাজে যোগ দেন তিনি। পরে ওই পরিবারেরই এক সদস্যের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। একটি কন্যা সন্তানেরও জন্ম দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে তাঁর কিছু সমস্যা তৈরি হয়। স্বামীর বিরুদ্ধে মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ এনে বাড়ি ছাড়েন পম্পা। ব্যারাকপুরে তাঁর মায়ের কাছে এসে ওঠেন। পম্পা জানান, এর কিছু দিন পরে মায়ের সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয় তাঁর। এক দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। আদালতের নির্দেশে তাঁর স্থান হয় পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। আর ওই সময়েই তাঁর স্বামীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তাঁর মেয়েকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। শিশু কল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধানে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি হোমে। এ দিকে, টানা মাস কয়েক পাভলভে থাকার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন পম্পা। তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান তাঁর মা। আর তার পরেই শুরু হয়ে যায় আসল লড়াই।

পম্পা জানান, হাসপাতালে গিয়ে তিনি এই সমস্যার কথা জানানোর পরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। আগাগোড়া পাশে থেকে পম্পাকে সব রকম আইনি সাহায্য দেন মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। প্রথমে ব্যারাকপুর এসডিজেএম আদালত এবং পরের ধাপে হাইকোর্টে সন্তানের অভিভাবকত্বের লড়াইয়ে জিতে যান পম্পা।

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লিগাল অফিসার অধিরাজ রায় বলেন, ‘‘এক বার কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে ধরেই নেওয়া হয় যে তিনি আর কখনও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবেন না। তাই তাঁর সব রকম অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সেই চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালের তরফে আমরা সকলে এবং শিশু কল্যাণ সমিতি সম্মিলিত ভাবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই শিশুটি তার মায়ের কোলে ফিরতে পেরেছে।’’

প্রশ্ন হল, সন্তানকে নিজের কাছে রাখার লড়াইয়ে না হয় জিতে গেলেন পম্পা। কিন্তু এর পরে? মেয়েকে বড় করার আর্থিক সংস্থান হবে কী ভাবে? পম্পা জানান, পাভলভ চত্বরে সেরে ওঠা মনোরোগীদের নিয়ে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যে ক্যান্টিন চালায়, আপাতত সেখানেই চাকরি পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘এখান থেকে কিছু উপার্জন হচ্ছে। ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পড়েছি। আরও কী কী করতে পারি, সেটাও ভাবছি। যত পরিশ্রমই হোক না কেন, মেয়েটাকে নিয়ে স্বাধীন ভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE