কেউ ডাকেন ‘জানাদা’, কেউ বা ডাকেন ‘প্রবীরদা’। কেউ পরিচিত ‘সজলবাবু’ নামে।
ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে নার্স-মেট্রন, এমনকী চিকিৎসকদের সঙ্গেও তাঁদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কোন রোগীর কবে কী রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে, সব লেখা আছে তাঁদের খাতায়। এনআরএস তো বটেই, আরজিকর-মেডিক্যাল কলেজ-ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ— রোগী কলকাতার যে সরকারি হাসপাতালেই ভর্তি থাকুন না কেন, প্যাথোজিক্যাল পরীক্ষার জন্য এই প্রবীর জানা, সঞ্জীব দাস, সজল রায়-রা তাঁদের জন্য হাজির। এনআরএস হাসপাতালের এক রোগিণীর ভুয়ো রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে হইচইয়ের আবহে খোঁজখবর নিতে গিয়েই উঠে এসেছে এঁদের নাম।
রোগিণী রেবা চট্টোপাধ্যায়ের রক্তের নমুনা এনআরএস থেকে নিয়ে গিয়েছিল শিয়ালদহের একটি ক্লিনিক। তারা সেই রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠায় সুকান্তনগরের একটি ল্যাবে, যেটি আদ্যন্ত ভুয়ো বলে জানা গিয়েছে আনন্দবাজারের তদন্তে। রোগিণীর পরিবারের অভিযোগ ছিল, সরকারি হাসপাতালের জুনিয়ার ডাক্তাররাই ওই ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। শিয়ালদহ ক্লিনিকের কুরিয়ার বয়ও দাবি করেছিলেন, এমন চক্র অন্য হাসপাতালগুলিতেও সমান সক্রিয়। সোমবার খোঁজ নিতেই তাঁর দাবির সত্যতা আনন্দবাজারের সামনে এসেছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারেরাই গড়গড় করে প্রবীর জানা, সঞ্জীব দাস, সজল রায়দের নাম বলে গিয়েছেন। এঁদের কাজকর্ম এবং বেসরকারি ল্যাবগুলির হালহকিকত সম্পর্কে তাঁরা যে দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল, তা-ও গোপন থাকেনি।
যেমন ‘সজলবাবু’র নিজেরই কথায়, ‘‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের বেশির ভাগ চিকিৎসক এবং ওয়ার্ডবয়ের সঙ্গেই আমার জব্বর খাতির। যে কোনও ওয়ার্ডে ঢুকে অনায়াসে রোগীর রক্ত নিয়ে নিয়ে আসতে পারি। চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখতে পারেন।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখা হল এমনই আর এক জনের সঙ্গে। তাঁর হাতে ধরা রোগীর তালিকা। খুল্লমখুল্লা জানিয়ে দিলেন, ‘‘একটু বেশি টাকা খরচ করলেই যে কোনও ধরনের প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা বাইরের নামী ল্যাবরেটরি থেকে করিয়ে দেব। আর টাকা খরচের ক্ষমতা না থাকলে অনেক কম খরচেও রিপোর্টের ব্যবস্থা করা যাবে। তবে সেই ল্যাবরেটরি সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত হবে বা তার রিপোর্ট সঠিক হবে, সে ব্যাপারে গ্যারান্টি থাকবে না।’’
এই মুশকিল আসানদের সন্ধান রোগীরা পান কোথা থেকে? ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বাইরে একটি পানের দোকানে খোঁজ করতে নিজে থেকেই ধরা দিলেন এক ল্যাব এজেন্ট। তাঁর দাবি, ‘‘সব ওয়ার্ডের ওয়ার্ডবয়দের ফোন নম্বর আমার মুখস্থ। ওঁরাই তো আমাদের লক্ষ্মী। আর যদি কোনও ডাক্তারবাবুকে ম্যানেজ করতে পারি তা হলে তো কথাই নেই।’’
কেউ নিজের পরিচয় গোপন করে নিজেদের কার্যকলাপ বোঝাচ্ছেন। কেউ বা পরিচয় দিয়েই কথা বলছেন। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে যেমন সঞ্জীব দাস দিব্যি ঘুরে বেড়ান এ ওয়ার্ড থেকে সে ওয়ার্ড। তিনি শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের এক ল্যাবরেটরির এজেন্ট। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘‘অস্ত্রোপচারের আগে রোগীদের কিছু রক্তপরীক্ষা লেখা হয়। কিছু চিকিৎসক ও ওয়ার্ডবয়ের বদান্যতায় প্রতিদিন সঞ্জীব দাসের কাছে সেই তালিকা পৌঁছে যায়। তিনি ওয়ার্ডে ঢুকে রোগীর গায়ে সিরিঞ্জ ফুটিয়ে রক্ত নিয়ে চলে যান।’’
এক রোগীর আত্মীয় সেজে যোগাযোগ করা হল সঞ্জীববাবুর সঙ্গে। কথাবার্তায় স্মার্ট। বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা আমার নাম বলেছেন তো? কোনও চিন্তা করবেন না। আমি রক্ত নিয়ে গেলে অনেক সস্তায় হয়ে যাবে। আপনি নিজে রক্ত নিয়ে এলে সেই ডিসকাউন্টটা পাবেন না।’’
আপনাদের ল্যাবরেটরির লাইসেন্স-টাইসেন্স রয়েছে তো? ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘‘অত জানাতে পারব না। করবেন কি না বলে দিন, তা হলে কাল গিয়ে রক্ত নিয়ে আসব।’’ একটু কমে হবে না? সঞ্জীবের পরামর্শ, ‘‘হাসপাতালের বাইরেই একটা পানের আর একটা চশমার দোকানের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। ওদের বললে ওরাই ব্যবস্থা করে দেবে। তবে লাইসেন্সওয়ালা ল্যাবরেটরি পাবেন না বলে দিলাম।’’
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আবার দিলেন ‘সজল রায়’ নামে এক জনের নম্বর। আবারও ফোন করা হল রোগীর আত্মীয় সেজে। সজল বললেন, ‘‘শ্যামবাজারের ভাল ল্যাবরেটরিতে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবুরা তো সব জানেন।’’ তাঁকে বলা হল, খরচটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। শুনে চটজলদি সমাধান করলেন, ‘‘শিয়ালদহে ১৯টা ল্যাবরেটরির সঙ্গে কাজ হয় আমাদের। কমে হয়ে যাবে।’’
ল্যাবরেটরিগুলির লাইসেন্স আছে তো? সজল পাক্কা সেলসম্যানের মতো জবাব দিলেন, ‘‘রিস্ক নেবেন? ওই সব ল্যাবে কারও হয়তো ডপলারের বা টিএমটি-র লাইসেন্স জোগাড় হয়নি! ভরসা দিতে পারব না!’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচিত এজেন্ট প্রবীর জানাও পরপর পাঁচটা ল্যাবরেটরির নাম করে বললেন, ‘‘কম খরচ চাইলে এগুলোতেও করাতে পারেন তাহলে। কিন্তু রিপোর্টের কোনও গ্যারান্টি থাকবে না।’’ এই সব ল্যাব চলছে কী ভাবে? আরজিকরের এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘অর্ধেক কালেকশন সেন্টারে নমুনা সংরক্ষণের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। অর্ধেক ল্যাবরেটরির রেজিস্ট্রেশন করা নেই। অথচ আমাদের কিছু সহকর্মী সেখানেই রোগীদের রেফার করে দিচ্ছেন।’’
কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন এঁদের কাজকর্ম, নাম-ধাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তখন স্বাস্থ্য দফতর কেন সার্বিক ভাবে এদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত চালায় না? স্বাস্থ্যকর্তাদের থেকে কোনও জবাব মেলেনি। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে বা এসএমএস করে উত্তর পাওয়া যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy